Sunday 14 April 2024

বাংলা ভাষা যখন দুয়োরানি

বাংলা শিক্ষার হাল-হকিকত

প্রজ্ঞা পারমিতা



বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা ধরনের হা-হুতাশ সরিয়ে রেখে, যারা ভাষাটা শিখছে তাদের মধ্যে কিছু কাজ করে যদি সামান্যতম পরিবর্তনও আনা যায়, সেই তাগিদ থেকে আমরা স্কুলে স্কুলে বাংলা বানান প্রতিযোগিতার আয়োজন করা শুরু করি ২০২২ সাল থেকে। বিগত তিন বছর ধরে সেই কাজ করতে করতে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থা, বিশেষত বাংলা শিক্ষার মান নিয়ে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি তা জানানোর উদ্দেশ্যেই আজ লিখতে বসা। যদিও আমরা কী করেছি তার ঢক্কানিনাদ করা আমার উদ্দেশ্য নয়, কিন্তু বাংলা ভাষা শেখা ও শেখানোর যে বাস্তব ছবিটা পেয়েছি, তা কী করে সম্ভব হল, সে সম্পর্কে প্রথমে একটু লিখতেই হবে; অন্যথায় পূর্বোক্ত ‘আমরা’ কথাটাও স্পষ্ট হবে না। 

বাংলা নিয়ে বানান প্রতিযোগিতার এই ভাবনাটি সুমন গাঙ্গু্লি মহাশয়ের। তিনি ও আমি ‘হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব’ নামে একটি দল পরিচালনা করি যার উদ্দেশ্য বাংলা ভাষা চর্চা। এই গোষ্ঠীর নামেই আমরা প্রতিযোগিতাটি করি যার নাম দিয়েছি ‘বানানবাজি’, সহজ ভাষায় যার অর্থ বানানের বাজি। এখন কথা হল, বানান প্রতিযোগিতা– এই শব্দবন্ধ উচ্চারিত হওয়া মাত্র নিশ্চিত সবার মনে ‘স্পেলিং বি’ এই শব্দ দুটোই ঘাই মারে। অথবা মনে পড়তেও পারে রিচার্ড গিয়র ও জুলিয়েট বিনোশে অভিনীত ‘বি সিজন’ ছবিটির কথা, যে ছবি পৌঁছে দেয় শব্দ ও অক্ষরের অমেয় রহস্যময়তার কাছে। কিন্তু যদি বলি বাংলা বানান প্রতিযোগিতা, তবে মগজের লিঙ্ক-লিস্ট বেমালুম ঘাবড়ে যায়। আসলে দুয়োরানি বাংলা ভাষার তেমন কিছু নেই যে! এই ছবিটা বদলাতে চাইছিলাম আমরা। লক্ষ্য ছিল বাংলা ভাষা সম্পর্কে একটা আবেগময় সচেতনতা সৃষ্টি ও শুদ্ধ বাংলা শেখার প্রতি আগ্রহ তৈরি করা। এই লক্ষ্য হয়তো অনেকের অতিউচ্চাশী মনে হবে। কিন্তু বাংলা ভাষার কাছে দায়বদ্ধতা থেকেই যাবতীয় দ্বিধা-সংশয় নস্যাৎ করে সেই ভাবনাকে বাস্তব রূপ দিতে ঝাঁপ দিয়েছিলাম আমরা। আমি দেখেছি, কী অবলীলায় একজন সর্বোচ্চ প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রিধারী বাঙালি ‘স্বর্গ’ এবং ‘সর্গ’-- এই দুটো বানানের প্রভেদ না করে প্রবন্ধ লিখে ফেলেন। আমি নিশ্চিত তিনি ‘night’ এবং ‘knight’ বানান দুটি যে আলাদা তা যত্ন নিয়ে খেয়াল রাখেন। কিন্তু বাংলার বেলায় সেই দায় নেই কেন? এত তাচ্ছিল্যই বা কেন? সুতরাং, 'catch them young'।

এ কথা সত্যি যে বাংলা বানান নিয়ে সমস্যা আছে। নতুন বানান বিধি, পুরনো বানান, কাগজে কাগজে প্রচলিত ইচ্ছেমতো বানান– এইসব নিয়ে সে এক ঘোর অবস্থা। কিন্তু যারা বাংলা শিখতে শুরু করেছে তাদের তো একটাই এবং সঠিকটা শিখে নিতে সাহায্য করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে বুঝিয়ে দিতে হবে যে বাংলা ভাষা তার কাছে একটু যত্ন দাবি করে। আমরা সেই ভাবেই সাজাই আমাদের প্রতিযোগিতা। মধ্য শিক্ষা পর্ষদের বাংলা পাঠক্রম আধুনিক বানান বিধি অনুসরণ করে। আমরা সাধারণত অষ্টম, নবম এবং দশম শ্রেণিতেই এই প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করে থাকি এবং তাদের জন্য নির্দিষ্ট পাঠ্যবই থেকেই শব্দ বাছাই করি। তাদের যত দূর পড়ানো হয়েছে খোঁজ নিয়ে সেই অংশ থেকেই বানান ধরা হয়। অর্থাৎ, তাদের শক্ত বা অজানা শব্দ ধরে ভড়কে না দিয়ে, যা শিখছে সেটাই কতটা শিখেছে তা একটা আনন্দানুষ্ঠানের মোড়কে বুঝতে পারার সুযোগ তৈরি করা।  

এই প্রতিযোগিতাটি হয় দুটি পর্যায়ে, যার দ্বারা ছাত্রছাত্রীদের লেখার দক্ষতা ও শুদ্ধ বানান সম্পর্কে জ্ঞান এই দুটো বিষয়েরই আন্দাজ পাই আমরা। প্রথমত একটি ছোট অনুচ্ছেদ থেকে শ্রুতিলিখন দিয়ে সবচেয়ে কম বানান ভুলের উপর ভিত্তি করে প্রতিযোগী বেছে নেওয়া হয়। তারপর দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রত্যেককে দশটি করে বানান জিজ্ঞাসা করা হয়। এভাবে সেই স্কুলের পঠনপাঠন সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। এবং এই পদ্ধতিতে ক্রমাগত কাজ করতে করতে বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থার যে ছবিটা ধীরে ধীরে বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আমাদের কাছে তারই আভাস দেওয়ার চেষ্টা করছি বর্তমান লেখায়।

আমরা সরকারি, আধা-সরকারি ও বেসরকারি তিন ধরনের স্কুলেই কাজ করেছি, ইংরেজি ও বাংলা দুটি মাধ্যমেই। কলকাতা ও মফসসলের বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলিতে কিন্তু বিস্তর ফারাক, সে ছাত্র সংখ্যা বা শিক্ষার মান যে দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা যাক। কলকাতার সরকারি ও আধা-সরকারি বাংলা মাধ্যম স্কুলের ছবি অত্যন্ত হতাশাজনক, অবশ্যই হাতে গোনা কয়েকটি বাদ দিয়ে। ছাত্রছাত্রী সংখ্যা অতি অল্প এবং ক্রমাগত নিম্নগামী। পড়াশোনার মান কল্পনাতীত রকমের খারাপ। অবশ্যই প্রতি ক্লাসে একজন বা দুই জন ভালো ছাত্র বা ছাত্রী আমরা পেয়ে যাই, কিন্তু তাতে সামগ্রিক চিত্রে কিছু হেরফের হয় না। অধিকাংশ স্কুলে ৭০ শতাংশ ছাত্রকে একটি ছোট্ট অনুচ্ছেদ লিখতে গিয়ে ৩০ থেকে ৩৫টি বানান ভুল করতে দেখেছি। অতি সাধারণ বানানও ভুল করা দেখে বোঝা যায় যে তারা উচ্চারণ বুঝে বানান করে লিখতেও শেখেনি। বহু খাতা পড়ে ওঠা দুষ্কর বলে বাতিলও করতে হয়। প্রথমেই জানিয়েছি যে আমরা তাদের পাঠ্যবই থেকেই শ্রুতিলিখন দিয়ে থাকি এবং অবশ্যই সেই সময় ক্লাসে যত দূর পড়ানো হয়েছে তা থেকেই। এবং আমরা যে আসছি তা আগে থেকেই তারা জানে। তবুও এ হেন ভুল দেখে নানা ধরনের প্রশ্ন জাগে মনে যার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি। 

দ্বিতীয় পর্যায়ে আমরা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বানান ধরি তাদের। এই পর্যায়ে যেহেতু সবচেয়ে ভালো ছাত্র বা ছাত্রীকে আমরা তুলে নিয়েছি, তাই দশটির মধ্যে দশটি বানান ঠিক করেছে এমন বহু ক্ষেত্রেই দেখেছি। কিন্তু কোথাও আবার আরও হতাশাজনক অবস্থা পেয়েছি। বেশ কয়েকটি স্কুলের ছাত্রীদের যথাযথ বর্ণপরিচয় হয়নি। তারা আঙুল দিয়ে বাতাসে লিখে অক্ষর বোঝাচ্ছে। এ-কার উ-কার ইত্যাদিও আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে। তাদের যুক্তাক্ষর পরিচয় নেই। কোন অক্ষরের সঙ্গে কোন অক্ষর জুড়ে সেই যুক্তাক্ষরটি তৈরি হয়েছে সে ধারণা ভাসা ভাসা। এই ভয়াবহ ছবিটা পেয়েছি বেশিরভাগ সিক স্কুলে বা হাবে। এখানেই একটা প্রশ্ন আসতে বাধ্য। সিক স্কুলগুলোতে কিন্তু ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত শক্তিশালী। একটি স্কুলে যদি ১৬৩ জন ছাত্রী হয় এবং ১০ জন শিক্ষিকা তবে তো অতি অল্প সংখ্যক ছেলেমেয়েকে পড়াতে হয় এবং ব্যক্তিগত খেয়াল রাখা আরও সুবিধাজনক হয়ে দাঁড়ায়। শ্রুতিলিখন দিতে গিয়ে দেখেছি ৯ জন ছাত্রী একটি ক্লাসে, কিন্তু নবম শ্রেণির ছাত্রী অতি সাধারণ বানান করে উঠতে পারা তো দূর, অক্ষরের নাম উচ্চারণ করতে পারছে না। এ ক্ষেত্রে কি শিক্ষকরা দায় এড়াতে পারেন?! তাঁদের পড়ানোর আগ্রহ নিয়েও কি সংশয় জাগা স্বাভাবিক নয়।

প্রথমত এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে নামী দামী হাতে গোনা কয়েকটি স্কুল ছাড়া আজ বেশিরভাগ বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়তে আসে নিম্নবিত্ত পরিবারগুলি থেকে। এবং তাদের অনেকেই প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া। একটি ছেলের নাম বাপি দাস। এতেই স্পষ্ট যে একটা ভালো নাম রাখাও বিলাসিতা তাদের পরিবারে। তাহলে এটাও বোঝা যায় যে তার বাড়িতে পড়ায় ভুল ধরানোর মতো কেউ নেই। সে যেটুকু শিখবে স্কুল থেকেই, সে ক্ষেত্রে স্কুলের  দায় আরও বেড়ে যায় না কি? অথচ আমরা একটি স্কুলে ক্লাস টেনের ছাত্রকে তার নামের বানান লিখতে দেখলাম 'দিপায়ন' দাস। প্রশ্ন করে জেনেছি, প্রথম শ্রেণি থেকে দশম পর্যন্ত দশ বছর সে ওই স্কুলেই পড়েছে। তবু কেউ তার বাংলা নামের ভুলটুকু শুধরে দেয়নি। আজকাল নানা খাতে সরকারি সাহায্য পাওয়ার কার্ডে নাম তোলাতে হয়। সে দোহাই দিয়েও ভুল রেখে দেওয়া অযৌক্তিক, কারণ, ভোটার কার্ড থেকে আধার কার্ড সবই শোধরানো যায়। এই প্রশ্ন সংশ্লিষ্ট বাংলা শিক্ষিকাকে করায় উত্তর পেয়েছিলাম, 'আজকাল তো কোথাও বাংলায় নাম লিখতে হয় না, পরীক্ষার খাতায়ও ইংরেজিতে নাম লেখাই দস্তুর। তাই জানাই যায় না যে বাংলায় তারা কোন বানান লেখে।' স্তম্ভিত হতেও ভুলে গিয়েছিলাম এই জবাব পেয়ে। ছাত্রছাত্রীদের বিষয় ভিত্তিক একটি খাতা থাকার চল কি আজ আর নেই! বাংলা খাতায়ও কি তারা ইংরেজিতে নাম লিখে থাকে?!

চিরকালই কিছু স্কুল সাধারণ হত, কিছু স্কুল নামকরা হত-- স্কুলের পড়াশোনার মান ও ছাত্রছাত্রীদের মানের উপর ভিত্তি করে। আমাদের অনেকের বাবা মায়েরাই হয়তো সাধারণ স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। কিন্তু এত ভয়াবহ পড়াশোনার মান কী আগেও ছিল? আলোচনা করে দেখেছি, সম্ভবত না। আমি কিন্তু কলকাতার বাংলা মাধ্যম সরকারি বা আধা-সরকারি স্কুলের কথাই বলছি, অবশ্যই কিছু নামী স্কুলের কথা বাদ রাখছি। 

আরও কিছু অদ্ভুত সত্যের মুখোমুখি হয়েছি আমরা। কলকাতার বেশ কিছু অঞ্চলের স্কুলে আমরা একশো শতাংশ মুসলমান ছাত্র বা ছাত্রী পেয়েছি। একটা ভালো দিক যে তারা মাদ্রাসায় পড়াশোনা না করে মূল স্রোতের স্কুলে পড়াশোনা করছে। কিন্তু তারা অনেকেই হিন্দিভাষী। বোঝা যায় অন্য সুবিধা গ্রহণে অপারগ হয়েই তারা বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়ছে। এই স্কুলগুলিতে আগে থেকেই আমাদের জানিয়ে রাখা হয় যে এরা বাংলা পারে না, কারণ, এরা সবাই অবাঙালি। আশ্চর্যের বিষয়, আমরাও তো অ-ইংরেজ হয়েই A B C D শিখতে পেরেছি। সেখানে একটি নবম শ্রেণির ছাত্রীর অক্ষর পরিচয় না থাকাটা কি তার অবাঙালি হওয়াকে দায়ী করা যায়? অবশ্যই পাশ ফেল তুলে দেওয়া জাতীয় নানা সরকারি সিদ্ধান্ত শিক্ষার অবনমন ঘটিয়েছে। অনতি অতীতের কোভিড একটি ব্যাচকে দুর্বল করে দিয়েছে নিশ্চিত। কিন্তু তারপরেও কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়। পাশ ফেল উঠে যাওয়ায় ঠিকঠাক শেখানোর প্রয়োজনটাও কি উঠে যায়?! তাহলে নৈহাটি বা বহরমপুরের স্কুলে অন্যরকম ছবি কেন দেখলাম! এমন কি শহরতলির স্কুলেও। সে সব স্কুল তো চিরকালীন স্বাভাবিক ছবিই আঁকলো– কিছু অমনোযোগী, কিছু সাধারণ এবং বেশ কিছু ভালো ছাত্রছাত্রী পেয়েছি যাদের নিয়ে অসাধারণ সুন্দর কিছু মুহূর্ত সৃষ্টি হয়েছিল বাংলা ভাষা ছুঁয়ে। 

এতক্ষণের আলোচনা ছিল বাংলা মাধ্যম নিয়ে। ইংরেজি মাধ্যম বেসরকারি স্কুলে পড়াশোনার মান অতিউচ্চ, কিন্তু বাংলা ভাষা সেখানেও দুয়োরানী। বেশিরভাগ বাংলায় নামটুকুও লিখতে শেখেনি। মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত এবং উচ্চবর্গ পরিবারের প্রদীপগুলি এই সব স্কুলেই জ্বলছে। কিন্তু চ্যাটার্জি, ঘোষ বা গুহদের ছেলেমেয়েদের অনেকেই বাংলায় নাম লিখতেই শেখেনি। এটাই আজকের বাস্তব চিত্র।

আরও জানতে, বাংলা বানানবাজি নিয়ে এই দৃশ্য-নিবন্ধটি দেখতে পারেন:

https://www.youtube.com/watch?v=6mAH6P3e0bo&t=7s


Thursday 4 April 2024

বেকারত্বের রহস্য!

অধিকাংশ মানুষের নিয়মিত কাজ না থাকাটাই ভবিতব্য?

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

সম্প্রতি, ইন্টারন্যাশনল লেবর অর্গানাইজেশন (আইএলও) প্রকাশিত ‘ইন্ডিয়া এমপ্লয়মেন্ট রিপোর্ট ২০২৪’ নানা দিক থেকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বেকারি বাড়ছে, আয় কমছে- এই প্রবণতাটি প্রতিবেদনটির মূল অক্ষ হলেও এর মধ্যে যে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের ধারা প্রবাহিত, তাকে বুঝতে হলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের দিকে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে।

এ কথা আগে বহুবার বলেছি, অর্থনীতি ও যাপন ক্ষেত্রের সর্বস্তরে কৃত্রিম বুদ্ধিমতার প্রয়োগে আপামর বিশ্বে এতাবৎকালের রাজনৈতিক অর্থনীতিতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। তা থেকে আমাদের দেশের অর্থনীতিও বাদ থাকেনি। যেমন, আইএলও’র প্রতিবেদন জানাচ্ছে, গত বেশ কয়েক বছর ধরেই ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের অনুপাত ১২ থেকে ১৪ শতাংশে স্থির থাকলেও নির্মাণ ও পরিষেবা ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানে বৃদ্ধি হয়েছে-- কৃষি থেকে শ্রম শেষোক্ত এই দুটি ক্ষেত্রে স্থানান্তরিত হয়েছে। কিন্তু কোভিডের পর এই চিত্র সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, অ-কৃষি ক্ষেত্র থেকে কৃষি ক্ষেত্রে শ্রম স্থানান্তকরণের উলটো প্রক্রিয়াই এখন চরম বাস্তব। স্বভাবতই, কৃষির ওপর এ এক ভয়ঙ্কর চাপ। কারণ আর কিছুই নয়, নির্মাণ ও পরিষেবা ক্ষেত্রে, বিশেষত পরিষেবা ক্ষেত্রে ডিজিটাল ব্যবস্থা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগের ফলে মনুষ্য শ্রমের চাহিদা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। সেই বাড়তি শ্রম ফিরে আসছে কৃষিতে। শুধু তাই নয়, ২০১৮ সালের পর থেকে স্থায়ী কর্মসংস্থানও ক্রমেই কমতে থেকেছে; পরন্তু, ২০১৯ সালের পর কর্মসংস্থানের যেটুকু বৃদ্ধি দেখা গেছে তার দুই-তৃতীয়াংশই ঘটেছে হয় স্বনির্ভর ক্ষেত্রে নয়তো বা মিলেছে বিনা মজুরিতে গৃহশ্রমের মহিলাদের পরিসরে। অর্থাৎ, কাজের বহু রসদ আছে, অফুরন্ত কাজের সুযোগও আছে, কিন্তু চাকরি নেই। কারণ, উৎপাদন প্রক্রিয়াটাই সার্বিক ভাবে হয়ে পড়েছে পুঁজি-নিবিড় ও প্রযুক্তি-নির্ভর। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এসে বিষয়টিকে আরও ত্বরান্ত্বিত করেছে।  

বোঝাই যাচ্ছে, আগামী দিনে চাকরির বাজার একপ্রকার অনিশ্চিত। শুধু তাইই নয়, ডিগ্রি-প্রাপ্ত অথবা উচ্চশিক্ষায় পাশ দেওয়া কর্মপ্রার্থীদের চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা আরও কম। কারণ, দক্ষতা-নির্ভর উচ্চশিক্ষিত-পাশদের এতদিনের বরাদ্দ কাজগুলি যন্ত্র এখন অনায়াসে আরও নিপুণ ও নিখুঁত উপায়ে দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করতে সক্ষম। জেনারেটিভ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জমানায় prompt লিখে দিলেই কেল্লা ফতে! যন্ত্র নিমেষের মধ্যে নির্ধারিত কাজটি করে দেবে। ‘ডেভিন’ নামে এমন এক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবস্থা এসে গেছে যে, সফটওয়ারের বিন্দু-বিসর্গ পর্যন্ত সে সমস্ত কাজ সমাধা করতে পারে। উপরন্তু, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ‘Agentic Workflows’ এখন থেকে মানুষের মতোই ধাপে ধাপে সৃজনশীল ও উদ্ভাবনের কাজগুলি করবে; যেমন, একটি কাজের প্রথমে খসড়া তৈরি করা, রাফ ওয়ার্ক, প্যাচ ওয়ার্ক মারফত তাকে আরও যথাযথ ও উপযুক্ত করে তোলা-- এইভাবেই যন্ত্রও এখন মানুষের কায়দাতেই প্রয়োজনীয় বিবিধ স্তরীয় বিন্যাসের মধ্য দিয়ে কাজগুলিকে সম্পন্ন করবে আরও অধিক উৎপাদনশীল ফলের জন্য। তফাত হল, যন্ত্রের কাজ হবে অত্যন্ত দ্রুততা ও নিপুণতার সঙ্গে, সর্বোপরি ত্রুটিহীন। তার মানে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত ব্যবস্থাপনা মানুষের দক্ষতাকে প্রতিস্থাপন করে তথাকথিত প্রতিষ্ঠান-পাশ ডিগ্রিধারীদের অকেজো ও অপ্রাসঙ্গিক করে দেবে। বরং, পরিশ্রমসাধ্য কায়িক কাজের প্রতুলতা এখনও কিছুকাল অদক্ষ ও কায়িক শ্রমিকের চাহিদাকে ধরে রাখবে। তার ইঙ্গিত উল্লিখিত প্রতিবেদনেও আছে। বলছে, আমাদের দেশে এখনও ৮২ শতাংশ মানুষ অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন এবং ৯০ শতাংশ মানুষ অনিয়মিত ভাবে নিয়োজিত। তথ্য এও বলছে, ২০২২ সালে যেখানে নিরক্ষর যুবকদের মধ্যে বেকারত্বের হার ছিল ৩.৪ শতাংশ, সেখানে স্নাতকদের মধ্যে তা ছিল ২৯.১ শতাংশ যা নিরক্ষর-বেকারি থেকে ৯ গুন বেশি। যেহেতু, দক্ষতার সঙ্গে উচ্চশিক্ষার অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক, আর এই দক্ষ কাজগুলিকেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত ব্যবস্থাপনা শুরু থেকে শেষ অবধি সম্পন্ন করতে পারদর্শী, তাই ‘উচ্চশিক্ষিত’দের মধ্যে বেকারির হার আরও বাড়বে। কারণ, ‘ভাল ও স্থায়ী’ চাকরির আশায় উচ্চশিক্ষায় ভর্তির হার ইদানীং কমে এলেও পাশের হারের বিচারে এখনও তা সংখ্যাগত ভাবে বেশি।

ফলে, একদিকে বেকারির হার বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে কর্মরত মানুষের মজুরি বা আয় কমছে। সংগঠিত ক্ষেত্রে নিত্য ছাঁটাই ব্যতিরেকেও মজুরি বা আয় কমছে, অসংগঠিত বা অদক্ষ কাজের এলাকাগুলিতে কাজের জোগান থাকলেও মজুরি ক্রমশই কমছে। আইএলও প্রতিবেদনের তথ্য দেখাচ্ছে, আমাদের দেশে অদক্ষ ও অনিয়মিত কৃষি শ্রমিকদের ৬২ শতাংশ ও নির্মাণ শ্রমিকদের ৭০ শতাংশ ন্যূনতম মজুরি পান না।

এইরকম পরিস্থিতির প্রেক্ষিতেই জনকল্যাণের রাজনীতি আজ প্রধান ভূমিকায় অবতীর্ণ। কারণ, প্রথমত, নগদ হস্তান্তরের মাধ্যমে (যেমন ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ বা ‘কৃষক বন্ধু’ প্রকল্প) পরিবারের প্রকৃত আয়কে কিছুটা বর্ধিত করলে সার্বিক গড় মজুরির পতনকে আপাতত সামাল দেওয়া যায়; দ্বিতীয়ত, নানান পরিষেবাকে বিনামূল্যে অথবা অর্ধমূল্যে প্রদান করতে পারলেও তা প্রকৃত আয়কে কিছুটা বাড়ায়! যেমন, ২০০ ইউনিট অবধি যদি বিদ্যুৎ বিনামূল্য পাওয়া যায়, অথবা, উন্নত বিদ্যালয়-শিক্ষা ও স্বাস্থ্য যদি সত্যি সত্যিই একেবারে বিনাপয়সায় মেলে, তাহলে তা যে প্রকৃত আয়কে বাড়ানোর পক্ষে সহায়ক, তা বলাই বাহুল্য। হয়তো, আগামী দিনে এই প্রবণতাই ‘ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম’এর এক সর্বতো ব্যবস্থা হয়ে দাঁড়াবে। যে মোদি সরকার কিছুদিন আগেও এই ধরনের জনকল্যাণমূলক অভিসারকে ‘রেউড়ি’ বলে গাল পেড়েছিল, আজ তারাও ‘মোদি কা গ্যারান্টি’ নামে এইগুলিকেই ফেরি করছে। কোনও কোনও দল, যেমন আরজেডি বলতে শুরু করেছে, তারা বিহারে ক্ষমতায় এলে ব্যাপক ভাবে সরকারি চাকরি দেবে। হয়তো অন্য দলগুলিও অচিরেই একই কথা বলবে। কারণ, সরকারি দফতরে কাজের চেয়ে লোক-নিয়োগের পাল্লা ভারী হলেও এই ব্যবস্থার প্রবর্তন করা যেতে পারে এই অভিসন্ধিতেই যে, কাজ নেই তো কী হয়েছে, মাসের শেষে মাইনে তো আছে— অন্য ভাষায় যা হয়তো বা, অথবা নিশ্চিত ভাবেই ‘ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম’ বলেও পরিগণিত হতে পারে!

কিন্তু রাজকোষে এত অর্থের জোগান দেবে কে? বলাই বাহুল্য, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এমন এক ব্যবস্থাকেই সাব্যস্ত করে লাগাম ধরেছে যেখানে মনুষ্য শ্রমের সমস্ত ভার সে বহন করতে সক্ষম; ফলে, এআই চালিত উৎপাদন ও পরিষেবায় কোনও খামতি থাকার কথা নয়, বরং, আরও নিখুঁত ও নিপুণ হওয়াই বাঞ্ছনীয়। দেখাও যাচ্ছে তা! অতএব, উদ্বৃত্ত আহরণের প্রক্রিয়াটিও অটুট রইল। সখেদে, রাজকোষে কর আদায়ও হয়তো আরও নিপাট হল। বুঝতে হবে, এ সময়ে কতিপয় পেশাদারকে বাদ দিলে যন্ত্রই স্বয়ম্ভু!

তাহলে অধিকাংশ মানুষের কি আর কাজ থাকবে না? ঠিকই, বাধ্যত মজুরি-দাসত্ব হয়তো আর থাকবে না। যখন শিল্প বিপ্লবের পর ইংল্যান্ডে ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে জোয়ার আসে তখন কারখানায় কাজ করার জন্য মজুর পাওয়া যেত না। গ্রাম থেকে তুলে এনে, রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো ভবঘুরেদের গ্রেফতার করে কারখানায় ঢুকিয়ে দেওয়া হত। কারণ, সেই অসহনীয় মজুরি-দাসত্বে কেউ স্বইচ্ছায় আবদ্ধ হতে চাইত না। পরে সেই রীতিই অভ্যাসে, প্রচারে ও আইনের চমকানিতে সর্বজনমান্য হয়েছে। ওষ্ঠাগত প্রাণে গত দু’ শতকে চাকরির নামে মানুষ এই মজুরি-দাসত্বকেই বহন করেছে। এর ভয়াবহ অভিঘাত ও চরম বিপন্নতা আমরা বারবার প্রত্যক্ষও করেছি। মার্কস এই মজুরি-দাসত্ব থেকে মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তবুও এই চক্র চলেছে, কারণ, মানুষের আর অন্য উপায় ছিল না।

কিন্তু যন্ত্রের অভূতপূর্ব উত্তরণে আজ যখন এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তির সম্ভাবনা প্রবল তখন ‘কর্মসংস্থান’ প্রদানের রাজনীতির নামে এই বদ্ধ অবস্থায় বন্দী রাখার প্রয়াস কেন? মানুষের জন্য ‘মজুরির বিনিময়ে অধিকাংশ কর্মই’ তো আর থাকছে না! যা মৃতপ্রায় তা নিয়ে এত মড়াকান্না কীসের? অভ্যাসের টান? বিপ্রতীপে, ঘরে বসে অথবা লোক-দেখানো সরকারি কর্মস্থলে গিয়ে মাস শেষে ‘ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম’ গোছের জুটে গেলে মানুষ তো এক অর্থে আংশিক মুক্তি লাভ করবে, নিজের পছন্দের কাজে মনোনিবেশ করতে পারবে। সে তো ভাল কথা। কিন্তু মৌলিক ব্যবস্থাপনাটি যেহেতু অর্থ বৈষম্যের সমস্ত উপাদান নিয়ে এখনও ‘পুঁজিবাদ’ই থাকছে, তাই এর বিবর্তন ও অভিঘাতগুলি বাস্তবে কেমনতর হবে তা এখনও কিঞ্চিৎ অনিশ্চিত! সম্মুখ পানে আরও খানিক এগোনো যাক না হয়! আওয়াজ উঠুক, 'ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম' চালু করো।

 

Tuesday 2 April 2024

বঙ্গে লড়াই ত্রিমুখি?

জোট না হওয়াই যখন 'ইন্ডিয়া'র পক্ষে লাভ

কল্যাণ সেনগুপ্ত



ত্রিমুখি লড়াই হলে সাধারণত যে কেন্দ্রে যার সাংগঠনিক ক্ষমতা বেশি, তার জয়ের সম্ভাবনাই অধিক। কিন্তু ব্যতিক্রমের সম্ভাবনাও আছে সীমিত ক্ষেত্রে, তবে নিশ্চিত গোপনীয়তা রক্ষা করে। এ রাজ্যে সে সম্ভাবনা আছে শুধুই সিপিএম, কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে, যেখানে তৃণমূলের সাংগঠনিক ক্ষমতা প্রশ্নাতীতভাবে অনেক বেশি। 

আবার উল্টো সম্ভাবনাও আছে। যথা, যেখানে তৃণমূল অপেক্ষাকৃত দুর্বল এবং তাদের বিরোধী দু' পক্ষের মধ্যে গোপন বোঝাপড়া করে জয়ের সম্ভাবনাময় আসনগুলো যদি নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেওয়া যায়, ফলে তিন দলেরই প্রধান শত্রু তৃণমূল সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু এমন সম্ভাবনায় সবচেয়ে বড় বাধা হল জাতীয় রাজনীতির বাধ্যবাধকতা এবং ভোট শতাংশে সিপিএম ও কংগ্রেসের সাংগঠনিক অস্তিত্ব প্রমাণের দায়। কারণ, ২০১৯'র ভোটে বিজেপির হঠাৎই ১৮টি আসন প্রাপ্তি ও সিপিএম-কংগ্রেসের ভোট শতাংশে অভাবনীয় ধস নামা দু' দলেরই নেতৃত্বের মুখ পুড়িয়েছে, বিশেষভাবে সিপিএমের। ফলে, এবার তাদের দিক থেকে প্রাধান্য পাওয়া উচিত সাংগঠনিক জমি পুনরুদ্ধারের বিষয়টি। তার সঙ্গে আর একটি ব্যাপারও মাথায় রাখা উচিত- বহরমপুর ও মুর্শিদাবাদ আসন দুটি জয়লাভে এবার দু' দলেরই মুখ্য নেতা অধীর চৌধুরী ও মহঃ সেলিমের পক্ষে পরিস্থিতি কিন্তু বেশ খানিকটা সম্ভাবনাময়।

জাতীয় ক্ষেত্রে জোট 'ইন্ডিয়া' প্রথম দিকে যথেষ্ট উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি করলেও পরবর্তীকালে তা খানিকটা হতাশায় পর্যবসিত হয় কংগ্রেস নেতৃত্বের খামখেয়ালিপনা ও দলীয় স্বার্থবাদী চিন্তায়। অপরদিকে, মোদী তাঁর ভাবনার রূপায়ণে রামমন্দির সহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ড চালাতে শুরু করেন এবং এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে সমর্থ হন যে, দেশের আপামর জনসাধারণের মধ্যে খানিকটা বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হয়, মোদীর জয় সুনিশ্চিত ও তিনিই তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় ফিরতে চলেছেন। এমতাবস্থায়, জোট ইন্ডিয়ার অন্যতম পুরোধা নীতিশ কুমার নিজের প্রধানমন্ত্রী হবার সাধ পূরণ হবে না বুঝতে পেরে মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সি'টি রক্ষায় অধিক মনোযোগী হয়ে সম্ভবত শেষবারের মতো পাল্টি খেয়ে মোদীর শরণাগত হলেন এবং আশ্বাস দিলেন, ভবিষ্যতে আর কোনও এদিক-ওদিক করবেন না। শুনে মুচকি হাসি চাপতে পারলেন না মোদীও। এরপর জোট ইন্ডিয়াকে দুর্বল করতে ও নিজের শিবিরকে শক্তিশালী করতে চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখলেন না মোদী-শাহ জুটি। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্ব নির্বিকার, জোটের বৈঠক ডাকার কোনওরকম প্রয়োজনীয়তাই বোধ করল না তারা। ব্যস্ত রইল 'ন্যায় যাত্রা' নিয়ে। এই যাত্রার সময়জ্ঞান নিয়ে নানা মুখরোচক গল্প বাজারে চালু হল। যেমন, এক ছাত্রের যেই পরীক্ষার দিন ঘোষিত হয়েছে অমনি সে দ্রুত এক জিমে গিয়ে ভর্তি হল, কারণ সে শুনেছিল আগে স্বাস্থ্যরক্ষা জরুরি। জোটের বৈঠক ডাকায় কংগ্রেস নেতৃত্বের অনীহার বিষয়টি সত্যিই চূড়ান্ত রহস্যজনক। যৌথ উদ্যোগে পাটনা ও দিল্লির সভায় মানুষের মধ্যে বিপুল সাড়া কি জমিনি বাস্তবতার ইঙ্গিত করছে না? যৌথ প্রতিবাদ ও প্রচার শুরু করতে পারলে মোদীর পরাজয় যে সুনিশ্চিত, তা অনেকেরই দৃঢ় বিশ্বাস।

এ রাজ্যের চিত্রটি অতএব বেশ জটিল। জাতীয় ক্ষেত্রে জোট ইন্ডিয়ার শরিক কংগ্রেস, তৃণমূল ও বাম তথা সিপিএম সবাই। এমনকি জোটের নামকরণেও মমতার প্রস্তাবই গৃহীত হয়। ফলে, মোদী শিবিরে প্রচণ্ড অস্বস্তি ও বিরোধ দেখা দেয়। এমনকি সরকারি অনুষ্ঠানেও প্রথম দিকে দিশেহারা হয়ে শাসকের তরফে ইন্ডিয়ার বদলে ভারত ব্যবহারের ছেলেমানুষী লক্ষ করা যায়। পরে ধীরে ধীরে মোদীর সম্বিত ফেরে ও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। এখন বিজেপি নেতৃত্ব ব্যঙ্গ করে বলে 'ইন্ডি জোট'। অর্থাৎ, জোটের নামকরণে যে প্রবল অস্বস্তি মোদী শিবিরে পরিলক্ষিত হয়, তা নিঃসন্দেহে নামকরণে সাফল্যেরই পরিচায়ক।

এ রাজ্যে জোট গঠনের আলোচনার শুরুতেই সিপিএম জানিয়ে দেয়, এ রাজ্যে তাদের পক্ষে তৃণমূলের সঙ্গে জোট গঠন সম্ভব নয়, বরং তারা আগ্রহী কংগ্রেস ও আইএসএফের সঙ্গে জোট গড়ায় এবং তারা তৃণমূল, বিজেপি দু' দলের অন্যায় শাসনের বিরুদ্ধেই লড়াই করতে চায়। এরপর রাজ্য কংগ্রেস নেতৃত্বও সাফ জানিয়ে দেয় যে, তৃণমূলের সঙ্গে জোট তারাও চায় না। কিন্তু কংগ্রেসের জাতীয় নেতৃত্ব ক্রমাগত জানাতে থাকে, জোট আলোচনা চলছে ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি এখনও। এমনই চরম বিভ্রান্তির মধ্যে ফয়সালার জন্য তৃণমূল সময় বেঁধে দেয় ৩১ জানুয়ারি। সময় পেরিয়ে যায়, কোনওরকম সদর্থক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয় কংগ্রেস। অবশেষে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে তৃণমূল সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে যে তারা ৪২টি আসনেই প্রার্থী দেবে অর্থাৎ জোটের সম্ভাবনায় ইতি ঘটে। তৃণমূলের এই সিদ্ধান্তের ফলে সিপিএম দলে খুশির হাওয়া বয়ে যায়। নিশ্চিন্ত হন অধীরও। 

এ রাজ্যে জোট হওয়া বা না হওয়ায় দু'রকমেরই সুবিধা বা অসুবিধে আছে।  প্রথমত, এ রাজ্যে জোট হলে কিছুটা রাজনৈতিক সুবিধা নিশ্চয়ই হত কিন্তু অঙ্কের হিসেবে খুব বেশি লাভ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। এখানে জোট বলতে ধরে নিচ্ছি শুধুই তৃণমূল ও কংগ্রেসের জোট, সিপিএম ব্যতিরেকেই। কারণ, সিপিএম অনেক আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিল যে, কোনও অবস্থাতেই তৃণমূলের সঙ্গে কোনও জোট নয়। যেমনটা কেরলে কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও জোট নয়। এ রাজ্যে যেমন সিপিএম তৃণমূল'কে বিজেপির দোসর বলে থাকে, ঠিক তেমনই কেরলে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বলে থাকে। সম্প্রতি কেরলের মুখ্যমন্ত্রী বিজয়নের মুখ থেকেও কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অভিযোগ শোনা গেল বিজেপির সঙ্গে গোপন আঁতাতের। ভোটের লড়াইয়ে এসব অভিযোগ গুরুত্বহীন। তবে অঙ্কের হিসেব মাথায় রাখতেই হয়। এ রাজ্যে জোট হলেও কংগ্রেসের কর্মী-সমর্থকদের ভোট আদৌ তৃণমূলের পক্ষে পড়ত কিনা, যথেষ্ট সন্দেহ আছে এবং অনুরূপ ভাবনা পারস্পরিক তিক্ততায় সর্বত্রই থাকার সম্ভাবনা প্রবল। ফলে, জোটের যথেষ্ট সদর্থক পরিবেশ এ রাজ্যে ছিল না।

এ রাজ্যের ভোট এখন মোটামুটি ভাবে দুটি শিবিরে বিভক্ত- তৃণমূল বনাম বিজেপি। তবে তৃতীয় পক্ষ আছে, যদিও বেশ কিছুটা পিছিয়ে, যেমন, সিপিএম ও কংগ্রেস। বাস্তব পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বলা যায়, এ রাজ্যে ভোটের অঙ্কে জোট হওয়ার চেয়ে না হওয়াটাই হয়তো তৃণমূল তথা জোট ইন্ডিয়া'র পক্ষে অধিক লাভজনক হতে চলেছে। ২০১৯'র ভোটে- সিপিএম ও কংগ্রেস- এই দু' দলেরই ভোট শতাংশ প্রচুর ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছিল। এখন দেখার, সেই হারানো ভোট কতখানি ফিরে আসে। বাস্তবতা হল, এই দু' দলের ভোট যদি গড়ে ১২-১৪ শতাংশ বাড়ে তবে বিজেপির আসন প্রাপ্তিতে যথেষ্ট ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কার আসন সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তা জানতে আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে ৪ঠা জুন পর্যন্ত।


Wednesday 27 March 2024

লাদাখের পথে মানুষ

ভূপ্রকৃতি পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র বাঁচানোর লড়াই

শান্তনু চক্রবর্তী



গতকাল (২৬ মার্চ) ইঞ্জিনিয়ার, উদ্ভাবক, বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মী সোনাম ওয়াংচুক ও অবসরপ্রাপ্ত সুবাদার সিরিং স্তানবা (Tsering Stanba) তাঁদের ২১-দিনের অনশন সত্যাগ্রহ সমাপ্ত করলেন। ওয়াংচুক বারে বারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং গৃহমন্ত্রী অমিত শাহকে লাদাখবাসীর ন্যায়সংগত দাবি ও বিজেপির নিজস্ব প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়েছেন। কিন্তু, কেন্দ্রীয় সরকারের হেলদোলের কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি। 

আজ (২৭ মার্চ) থেকে শুরু হচ্ছে লাদাখি মহিলা সংগঠনগুলোর লাগাতার দশ-দিনের উপবাস। তারপরে যুবকরা উপবাসে বসবেন; তারপরে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা এবং বয়স্ক মানুষরা। তারপর হয়তো ওয়াংচুক আবার। অর্থাৎ, চলবে। এই পরিস্থিতিতে লাদাখবাসীর আন্দোলন সম্পর্কে যে প্রশ্নগুলোর উত্তর মানুষ খুঁজতে চাইবেন, তার কয়েকটি নীচে আলোচনা করা হল।

প্রশ্ন ১) লাদাখ আন্দোলনের লক্ষ্য কী?

উত্তরআন্দোলনের লক্ষ্য—

লাদাখের পাহাড়গুলির অবস্থা যাতে হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড ও সিকিমের পাহাড়গুলির মতো না হয়

এবং

লাদাখের প্রকৃতি-পরিবেশ-বাস্তুতন্ত্র ও তার নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরম্পরা যাতে সুরক্ষিত থাকে

তার জন্য

সংবিধানের ষষ্ঠ তফশিল মারফত লাদাখের জনজাতি (ট্রাইবাল) অঞ্চলগুলির স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা ও অনতিদূর ভবিষ্যতে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল থেকে লাদাখ একটি স্বশাসিত রাজ্য হওয়া।

প্রশ্ন ২) ওয়াংচুক বারে বারে বলছেন যে বিজেপি লাদাখের মানুষের কাছে তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে। ঠিক কোন প্রতিশ্রুতির কথা বলা হচ্ছে?

উত্তর: ২০১৯ সালের লোকসভা এবং ২০২০ সালে লাদাখের পার্বত্য পরিষদ নির্বাচনে বিজেপি লাদাখের মানুষের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে লাদাখকে ষষ্ঠ তফশিলের অন্তর্ভুক্ত করবে যাতে লাদাখের মানুষের জমিজমা, কর্মসংস্থান, প্রকৃতি-পরিবেশ সুরক্ষিত হয়। লাদাখের লোকসভা আসন ও লেহ্‌-এর পার্বত্য পরিষদে বিজেপির জয়ের পেছনে এই প্রতিশ্রুতির একটা বড় ভূমিকা ছিল। 

লাদাখবাসীর রাজ্যের দাবিটি তুলনায় সাম্প্রতিক। বিজেপির প্রকাশিত নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির মধ্যে এটি ছিল বলে জানা যায় না। নির্বাচনী বক্তৃতায় অবশ্য এসে থাকতে পারে।      

প্রশ্ন ৩) ষষ্ঠ তফশিল অঞ্চল না হওয়ার ফলে লাদাখবাসীর কী অসুবিধা হচ্ছে এবং ষষ্ঠ তফশিল হলে লাদাখবাসীর ঠিক কী সুবিধা হবে?

উত্তর: ২০১৯ সালের অগস্ট মাস অবধি জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য ছিল সংবিধানের ৩৭০ ধারার আওতায়। এই সময়, লাদাখও ছিল জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের অন্তর্গত। ফলে, লাদাখের ক্ষেত্রেও বলবৎ ছিল ৩৭০ ধারা। ৩৭০ ধারা অনুযায়ী জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের বাইরের মানুষ বা বিনিয়োগকারী সংস্থা ওই রাজ্যে জমি কিনতে পারতেন না। সেই সুবাদে লাদাখেও জমিজমা ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর স্থানীয় মানুষের নিয়ন্ত্রণ ছিল।

২০১৯-এ ৩৭০ ধারা উধাও হল। তারপর, ২০১৯-এর নতুন আইনে লাদাখ জম্মু ও কাশ্মীর থেকে বেরিয়ে হয়ে গেল স্বতন্ত্র কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। অধিকাংশ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মতো তার কোনও বিধানসভা থাকল না। ফলে, আসল ক্ষমতা লেফটেনান্ট গভর্নরের হাতে। ওদিকে ৩৭০ ধারা না থাকায় জম্মু ও কাশ্মীরে এখন বাইরের লোকেরা জমি কিনছে; বাইরের বিনিয়োগ ঢুকছে, বাইরের লোক চাকরি পাচ্ছে। লাদাখিরা তা জানতে পারল। বুঝল, ৩৭০ ধারার অনুপস্থিতিতে এখন কেন্দ্রীয় সরকার বা যে-কোনও বিনিয়োগকারী সংস্থা আঞ্চলিক মানুষের ইচ্ছা-অভিরুচি-উদ্‌বেগ-আশঙ্কার তোয়াক্কা না করে এখানে যে-কোনও পরিমাণে জমি দখল করতে পারে— কেন্দ্রীয় সরকারের ছাড়পত্র নিয়ে প্রকল্প চালু করতে পারে। পার্বত্য পরিষদ দিয়ে তা আটকানো যাবে না। শুধু পারে না, তাই হওয়ার সূচনা হচ্ছে। কারণ, পরিষদের ক্ষমতা খুব সীমিত। গোটা লাদাখের উপর নিয়ন্ত্রণ লেফটেনান্ট গভর্নরের।  

ষষ্ঠ তফশিলের আওতাভুক্ত হলে লাদাখের জমিজমা প্রাকৃতিক সম্পদ সবই লাদাখের মানুষের গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের আওতায় আসবে। ষষ্ঠ তফশিলের রেওয়াজ অনুযায়ী, লাদাখে তৈরি হবে লাদাখি জনজাতি নির্বাচিত আঞ্চলিক ও জেলা পরিষদ এবং তারাই ঠিক করবে অঞ্চল ও জেলার অর্থনৈতিক বিকাশ কেমন ঢঙে ও কীভাবে হবে। তারা যেহেতু নিজেদের অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি-বাস্তুতন্ত্রকে নিবিড়ভাবে জানে ও সে সব সম্পর্কে তাদের স্বাভাবিক দরদ আছে, তাদের পক্ষে সে সবের সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে অর্থনৈতিক বিকাশের পরিকল্পনা করা সহজ হবে।   

প্রশ্ন ৪) কেন, ৩৭০-এর আওতা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর লাদাখে এমন কী ঘটেছে যাতে ওয়াংচুক বা অন্যান্য লাদাখবাসীর উদ্‌বেগের যথাযথ কারণ থাকতে পারে?

উত্তর: আজকাল বাইরের মানুষ লাদাখে অনেক বেশি সহজে পৌঁছতে পারলেও, মালপত্র-যন্ত্রপাতি লাদাখে পৌঁছনো কাশ্মীরের তুলনায় এখনও অনেক বেশি কঠিন। কিন্তু, ৩৭০ ধারার আওতা থেকে লাদাখ বেরিয়ে যাওয়ার পর কেন্দ্রীয় সরকার লাদাখে যোগাযোগ ব্যবস্থা বাড়ানোর ব্যাপারে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। কোভিড অতিমারীর জন্য সব কিছু দেরি হওয়া সত্ত্বেও, লাদাখে ৭৫০.২১ কিলোমিটার রাস্তা নতুন নির্মাণ হয়েছে কিংবা পুরনো রাস্তা সারানো হয়েছে, ২৯টি নতুন ব্রিজ তৈরি হয়েছে এবং ৩০টি নতুন হেলিপ্যাড বসেছে। পাশাপাশি তৈরি হচ্ছে শ্রীনগর থেকে কারগিলে সহজে পৌঁছনোর লক্ষ্যে জোজি লা সুড়ঙ্গ (Zoji La Tunnel), সহজে সীমান্তে পৌঁছনোর উদ্দেশ্যে তৈরি হচ্ছে কারগিল-জানস্কার রোড, এবং গতকাল সন্ধ্যাতেই সম্পূর্ণ হল লাদাখে পৌঁছনার তৃতীয় এবং সবচেয়ে কম কঠিন রাস্তা— ২৯৮ কিমি দীর্ঘ নিম্মু-পদম-দরচা রোড, যা লাদাখকে যুক্ত করল হিমাচল প্রদেশের সঙ্গে।

শুধু সীমান্তের সঙ্গে উন্নততর সংযোগ আর পর্যটন উৎসাহিত করা নয়, আরও ব্যাপার আছে। ২০০৭ সালেই উত্তর লাদাখের নুবরা-শিওক উপত্যকার ভূপ্রস্তরে পাওয়া গিয়েছে সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম-থোরিয়াম ডিপোজিটের হদিশ। চিনের সঙ্গে সীমান্ত অঞ্চল। তার উপরে দারুণ গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। তাই, ২০০৭-৮ সালের পর এই নিয়ে আর কোনও কথা মিডিয়াতে বা জনপরিসরে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে অনুপস্থিত।

এখানেই শেষ নয়!

ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি নির্মাণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত মূল্যবান যে প্ল্যাটিনাম গোষ্ঠীর ধাতু— যথাক্রমে প্ল্যাটিনাম, প্যালাডিয়াম, রোডিয়াম, রুথেনিয়াম, ইরিডিয়াম ও অসমিয়াম— সেই ধাতুগুলির আকরের সন্ধান মিলেছে লাদাখে। সবগুলোই দুষ্প্রাপ্য ও দামি। তার মধ্যে রোডিয়াম সোনার চেয়েও দামি।   

তাই, কেন্দ্রীয় সরকার ও নানা বিনিয়োগকারী যে লাদাখের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলির সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ স্থাপনে উৎসাহী হবেন তাতে আশ্চর্য কিছু নেই। আর, লাদাখের বিভিন্ন কোণে পৌঁছে যাওয়ার যোগাযোগ আরও সহজ হলে পর্যটন ও হোটেল ব্যবসায়ে বিনিয়োগকারীদের আটকে রাখা মুশকিল হবে। বাড়বে যোগাযোগ, হু হু করে বাড়বে গাড়ি, বাস, লরির যাতায়াত, বাড়বে হোটেল, রিসর্ট ও নানা কিসিমের পর্যটনকেন্দ্র। জলের মতো টাকা ঢুকলে পরিবেশ, স্বাস্থ্য, জননিরাপত্তা-সংক্রান্ত প্রাথমিক সুরক্ষা ও সাবধানতার নিয়মগুলো লঙ্ঘিত হতে থাকবে— যেমন হয়েছে উত্তরাখণ্ড, হিমাচল ও সিকিমে। পাহাড়ের সর্বনাশ হবে, হবে লাদাখবাসীর সর্বনাশ।

প্রশ্ন ৫) ওয়াংচুক বারে বারে বলছেন হিমবাহের কথা। সে সব কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে?

উত্তর: হিমালয় ও কারাকোরাম রেঞ্জের মধ্যে গুঁজে রয়েছে লাদাখ। জলবায়ু বদলের ফলে পৃথিবী জুড়ে হিমবাহ গলছে। বিপন্ন হচ্ছে এই গ্রহের নদীগুলি। সুমেরু ও কুমেরু অঞ্চলের বাইরে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি হিমবাহ আছে হিমালয় ও কারাকোরোম রেঞ্জের অন্তর্ভুক্ত অঞ্চলে। লাদাখের নদীগুলি এবং লাদাখবাসীর জলের জোগান হিমালয় ও কারাকোরাম রেঞ্জের হিমবাহগুলির উপর নির্ভরশীল।  

কিন্তু শুধু গ্রহের জলবায়ু বদলের জন্যই হিমবাহ গলছে তা নয়। আঞ্চলিক কাণ্ডকারখানার একটা বিরাট ভূমিকা আছে। যেমন, আপনার আশপাশের তাপমাত্রা যতটা গ্রহের জলবায়ুর উপর নির্ভরশীল ততটাই নির্ভরশীল আপনার আশপাশে কী ঘটছে তার উপর (যেমন আপনি ঘরের মধ্যে উনুনের কাছে আছেন নাকি পুকুর পাড়ে গাছের ছায়ায় আছেন), তেমনই হিমবাহের স্বাস্থ্যও নির্ভর করে পারিপার্শ্বিক কাণ্ডকারখানার উপর। হিমবাহের কাছাকাছি যদি নগরায়ন ঘটে, শয়ে শয়ে বা হাজারে হাজারে গাড়ি যায়, বড় নির্মাণকার্য হয়— স্বাভাবিকভাবেই পারিপার্শ্বিক তাপমাত্রা বাড়বে এবং হিমবাহ আরও বেশি বেশি করে গলবে। সাম্প্রতিক গবেষণা দেখাচ্ছে যে ২০০১ থেকে ২০১৯-এর মধ্যে, লাদাখের পাংগং এলাকার হিমবাহগুলি বেশ খানিকটা গলেছে। লাদাখের ব্যাপক ‘উন্নয়ন’ শুরু হলে সে সব হিমবাহর দশা কী হবে তা নিয়ে সন্ত্রস্ত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। ওয়াংচুক এসব প্রসঙ্গ এনেছেন।

প্রশ্ন ৬) ধরা যাক যষ্ঠ তফশিল হল। এমনকী লাদাখ একটি স্বতন্ত্র রাজ্য হল এবং নিজের বিধানসভা পেল। তাতেই কি এই সমস্যাগুলো উধাও হবে?

উত্তর: উধাও হবে এমন দাবি করা হচ্ছে না। কিন্তু এগুলো হলে কেন্দ্রীয় সরকার বা বাইরের কর্পোরেট সংস্থার পক্ষে ‘উন্নয়ন’-এর নামে আস্তিন গুটিয়ে লাদাখের ভূপ্রকৃতির বারোটা বাজানোর বন্দোবস্ত করা কঠিন হবে। এই কারণে অন্ততপক্ষে ষষ্ঠ তফশিলটুকু দরকার। রাজ্য হলে তো লাদাখবাসীর স্বনিয়ন্ত্রণের আরও সুবিধা।

তারপর বেশ খানিকটা লাদাখবাসীর হাতে থাকবে। জনজাতি গোষ্ঠীগুলির বহু শতাব্দী ধরে অর্জিত আঞ্চলিক পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র সংক্রান্ত কাণ্ডজ্ঞান এবং সোনাম ওয়াংচুক ও তাঁর দ্বারা প্রভাবিত মানুষজনের বুদ্ধি ও বিদ্যা যদি নির্বিচার লোভ ও মুনাফামুখী অর্থনীতি ও সংস্কৃতির প্রভাবকে অনেকটা লাগামে রাখতে পারে তাহলে লাদাখের ভূপ্রকৃতি-পরিবেশ-বাস্তুতন্ত্র অনেক দূর সুরক্ষিত হবে। মুসলমানপ্রধান কারগিল জেলা ও বৌদ্ধপ্রধান লেহ্‌ জেলার মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহের খানিকটা আবহাওয়া ছিল। গত দু-তিন বছরে তা অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। কারগিল ও লেহ্‌ একজোট হয়ে ষষ্ঠ তপশিল ও স্বতন্ত্র রাজ্যের দাবি জানাচ্ছে। ফলে, বিজেপি কোণঠাসা এবং কেন্দ্রীয় সরকার বিপদে পড়েছে। যদি এই সৌহার্দ্য টিকে থাকে ও ভবিষ্যতে আরও বাড়ে তাহলে লাদাখবাসীর সুবিধা। আর, রাজ্যের প্রশাসন ও ষষ্ঠ তফশিলের প্রশাসনের মধ্যে দ্বন্দ্বের যে সম্ভাবনা তার নিষ্পত্তির ফর্মুলা যদি তাঁরা বার করতে পারেন তাহলে তো সোনায় সোহাগা।

বুক ভরে আশা করতে দোষ কি?


Wednesday 20 March 2024

প্রোমোটারের দাপট

নগর যখন ভেঙ্গে পড়ে!

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

কলকাতা পৌরসভার ১৩৪ নং ওয়ার্ডে অবৈধ ভাবে নির্মীয়মাণ একটি বহুতল ভেঙ্গে এখন পর্যন্ত দশজনের মৃত্যুতে তুমুল সোরগোলের পর প্রোমোটার মহঃ ওয়াসিম ও জমির মালিককে গ্রেফতারি কতটা ক্ষতে মলম দেবে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। কারণ, শহরতলির অলিতে গলিতে চলমান যে অবৈধ হাইরাইজের নির্মিতি তা একদিনের ঘটনাক্রম নয় এবং ভবিষ্যতে যে এর ইতি ঘটবে তার তেমন কোনও ইঙ্গিতও নেই। সস্তার মালমশলায় ছোট ছোট খুপরিতে নাগরিকদের মাথা গোঁজার ঠাই করে দিতে যে ‘সামাজিক ব্যাধি’ (মেয়রের ভাষায়) আজ শহরের আনাচে কানাচে ডানা মেলেছে, তার রসদ বহু গভীরে। এর সঙ্গে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক যোগও যথেষ্ট সুবিদিত।

যদিও কাউন্সিলর অতীন ঘোষ এই দুষ্ট চক্রে রাজনৈতিক যোগের কথা স্বীকার করেছেন, এমনকি রাজ্যের শাসক দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষও অন্তর্নিহিত গভীর অন্যায়ের তদন্তের দাবিকেও মান্যতা দিয়েছেন, কিন্তু মহানাগরিক বিষয়টিকে ঠেলতে চেয়েছেন শুধুমাত্র প্রশাসনিক অকর্মণ্যতার দিকেই। বলাই বাহুল্য, এই ব্যাধি সাম্প্রতিক নয়, গত ২০-২৫ বছর ধরেই প্রোমোটার-দাপটে বহু অঞ্চলে সাধারণ নাগরিক যাপনে এক অস্থিরতা শুধু বিরাজই করেনি, উত্তরোত্তর তার ক্রমবৃদ্ধি এক তীব্র সংকটেরও জন্ম দিয়েছে। পুকুর ও জলাভূমি বুজিয়ে, নাগরিক পরিসরের সুস্থিতিকে তছনছ করে এর প্রকোপ দিনের পর দিন প্রবলতর হয়েছে। ‘টক টু মেয়র’ অনুষ্ঠানে সাহস করে বহু মানুষ এই তাণ্ডবের বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়েছেন, তৎক্ষণাৎ প্রশাসনিক আধিকারিকেরা ঘটনাস্থলে ছুটেও গিয়েছেন, কিন্তু কোনও এক যাদুবলে আবার তা কিছুদিন পরে ধামাচাপাও পড়ে গিয়েছে। বহু জায়গায় মানুষ নালিশ জানাতে ভয়ও পেয়েছেন। অর্থের জোর ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে ‘সব ঠিক হ্যায়’ গোছের এক ভারসাম্য বজায় থেকেছে। বাইক নিয়ে সপার্ষদ এই প্রোমোটারেরা এমন মেজাজে এলাকায় ঘুরে বেড়ায় যে নিরীহ জনতার কার ঘাড়ে কটা মাথা আছে তাদের বিরুদ্ধে কোথাও অভিযোগ জানানোর।

এই প্রবণতা শুধু কলকাতা শহরেই নয়, ভারতবর্ষের বহু মহানগরে আজ নাগরিক জীবনের কাছে এক ত্রাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। কলকাতার অ্যাডেড এরিয়ায় যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা ফ্ল্যাট রাস্তার পরিসর, পয়ঃপ্রণালীর বহন ক্ষমতা, পানীয় জলের জোগানের নাব্যতা- কোনও কিছুকেই ধর্তব্যের মধ্যে গণ্য করে না। আট-দশ ফুটের রাস্তায় দেড়-দু কাঠা জমিতেও অবাধে উঠে যাচ্ছে তিন-চারতলার ফ্ল্যাটবাড়ি। নির্মাণের শুরুতে লোকদেখানো নিয়ম মেনে আইন অনুসারে জমির কিছু অংশ রাস্তায় ছাড় দিয়ে ছোট পাঁচিল তুলে নির্মাণ সম্পূর্ণ করে তারপর সেই পাঁচিল ভেঙ্গে ছাড় দেওয়া রাস্তাকে আবার জমির অংশে ঢুকিয়ে নতুন করে পাঁচিল তুলে দেওয়া হচ্ছে। খুপরি ফ্ল্যাটের সংখ্যা বাড়াতে ও ঘরগুলিকে ঈষৎ বড় করতে নিয়মমাফিক জমির চারধারে ছাড় দেওয়ারও কোনও বালাই নেই। এইগুলি যে স্থানীয় কাউন্সিলর বা পৌরসভার আধিকারিকেরা জানেন না তেমনও নয়। কৌশলটা ভারী চমৎকার। হুড়হুড় করে ফ্ল্যাট তুলে চটজলদি তা বিক্রি করে দিলেই কেল্লা ফতে! কারণ, একবার ফ্ল্যাটবাড়িতে লোক ঢুকে গেলে ‘মানবিকতা’র স্বার্থে সে ফ্ল্যাটের অবৈধ অংশ আর নাকি ভাঙ্গা যায় না, এই যুক্তিতেই সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে যাবতীয় অপরাধ। উপরন্তু, ‘কমপ্লিশন সার্টিফিকেট’ বা ‘সিসি’ নেওয়ারও দায় প্রোমোটারদের নেই! তারা বিক্রি করেই ধা! ক্রেতারা এবার পৌরসভার দরজায় দরজায় ‘সিসি’র জন্য হন্যে হয়ে দৌড়চ্ছে মিউটেশনের জন্য।

আসলে, কলকাতা এবং মফস্বল শহরগুলিতে নগর পরিকল্পনা বলে কিছুই নেই। দু-একটি পার্ক তৈরি করে নগর পরিকল্পনার দায় ঝেড়ে ফেলা হচ্ছে। একটি পাড়া বা অঞ্চলে যেখানে রাস্তা অপ্রশস্ত, সেখানে বাড়িগুলির উচ্চতা কত দূর অবধি হতে পারে, ঘিঞ্জি পরিসরকে কতটা নিরাময় দেওয়া যায়, সে সবের কোনও দায়-ই নেই। সল্ট লেক বা নিউ টাউন যে ভাবে পরিকল্পনা করে গড়ে তোলা হয়েছিল, তার ছিটেফোঁটাও দ্রুত নগরে পরিণত হতে থাকা দূর-দূরান্তের শহরতলির ক্ষেত্রে দেখা যায় না। এখানে যেনতেন প্রকারেণ জমি হাতিয়ে ফ্ল্যাট তুলে বিক্রি করে দেওয়ার মধ্যেই নগরায়নের যাবতীয় কর্মকাণ্ড কেন্দ্রীভূত। ফলে, শহরতলি যেন ক্রমেই হয়ে উঠছে ইট-কংক্রিটের নতুন ‘পাকা’ বস্তি। আট কি বারো ফুটের রাস্তার ওপর দু-কাঠা জমিতে নির্মিত চার-পাঁচতলা ফ্ল্যাটের মধ্যে বাস করছেন প্রায় ৬০ থেকে ৮০ জন মানুষ। বহু জায়গায় পরিশ্রুত পানীয় জলের জোগান নেই, ফলে ডিপ টিউবেল বসিয়ে এতগুলি লোককে জল জোগাতে গিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে পাতালপুরী। আর এ তো একটা মাত্র ফ্ল্যাটে নয়, এরকম পাড়ায় পর পর দশটা বাড়িকে গুনতি করলে তার মধ্যে ৭ থেকে ৮টা বাড়িই এখন ফ্ল্যাট। অতএব, পরিস্থিতি কতটা ভয়ানক তা সহজেই অনুমেয়।

নিম্নমানের সস্তা মশলায় তৈরি ফ্ল্যাট ভেঙ্গে পড়ার আশঙ্কাই শুধু নয়, বিক্রির দু-তিন বছরের মধ্যে ক্রেতারা নিজ নিজ ফ্ল্যাটের অবস্থা দেখেও কপাল চাপড়াচ্ছেন। কোথাও পিলারে ক্র্যাক তো কোথাও ছাদ ভিজে উঠছে বৃষ্টির চুইয়ে পড়া জলে; অথবা, ঘরের দেয়ালে ফাটল নয়তো মেঝে উঠছে ঘেমে। সে ফ্ল্যাট বিক্রি করে পালানোর পথও নেই। কারণ, এই অবস্থায় নতুন ক্রেতাও অমিল। সময় গড়াতে ফ্ল্যাটগুলির অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে পড়ছে যে তা একপ্রকার মনুষ্য-বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। শরীর হয়ে পড়ছে রোগের ডিপো; শিশু অথবা বাচ্চাদের অবস্থা আরও শোচনীয়। ঘরে বা বারান্দায় জামাকাপড় মেলবার জায়গা নেই, ছাদে মেলতে গিয়ে সামান্য পরিসরে ফ্ল্যাট-প্রতিবেশীদের মধ্যে লেগে যাচ্ছে ধুন্ধুমার কাণ্ড। সব মিলিয়ে, স্থান সংকুলানের গোদের ওপর রোগভোগের বিষফোঁড়া।

কিন্তু কেন এই বাধ্যবাধকতা? ফ্ল্যাট বানালেই যে বিক্রি হবে তার তো কোনও মানে নেই। এখানেই একটি মজার চিত্র লুকিয়ে আছে। ছোট জমির ওপর ফ্ল্যাট তুলতে গিয়ে যদি পৌরসভার বিধি (জমি ছাড় ইত্যাদি) অমান্য করা যায়, ৪০০ থেকে ৫০০ বর্গ ফিটের অনেকগুলি ছোট ছোট ফ্ল্যাট একেকটা ফ্লোরে নির্মাণ করা যায়, বেআইনি ভাবে যতটা সম্ভব তলা (তিন থেকে পাঁচ) বাড়ানো যায়, এবং যতটা সম্ভব রড, সিমেন্ট ও স্টোনচিপে কারচুপি করে মশলা তৈরি করা যায় তাহলে এক লপ্তেই যে বিপুল মুনাফা ওঠে তা লটারিতে প্রথম পুরস্কার পাওয়ার চেয়ে কম কিছু নয়। অতএব, আপাত-দৃশ্যে ‘সস্তায়’ এই ক্ষুদ্রকায় ফ্ল্যাটগুলি নগদের বিনিময়ে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত ক্রেতাদের হাতে সহজেই তুলে দেওয়া যায়। এখানে ক্রেতা ও বিক্রেতার আপাত ভারসাম্যও সাধিত হয়। বলাই বাহুল্য, এই কারবারটা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক যোগ ব্যতিরেকে একেবারেই অসম্ভব। অন্যদিকে, ফ্ল্যাট তৈরির জমিগুলি আসে দুই তরফ থেকে- এক) পারিবারিক উত্তরাধিকারে একাধিক ওয়ারিশ হয়ে যাওয়ায় কারওরই যখন তেমন প্রাপ্তি কিছু নেই, প্রোমোটারের হাতে তুলে দিলে বরং ফ্ল্যাট নয়তো নগদ মিলতে পারে; দুই) অবসরের পরে বাড়ি করার উদ্দেশ্যে, ২০-২৫ বছর আগে সস্তায় কিনে রাখা ২-৩ কাঠা জমির বিনিময়ে যদি মুফতে ফ্ল্যাট ও নগদ মিলে যায় তাহলে তার থেকে সহজে কিস্তিমাত আর কী হতে পারে!

তাই, জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা প্রোমোটার-রাজ যে আজ শুধু এক ‘সামাজিক ব্যাধি’ নয়, বরং, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক যোগসাজসে এক মাফিয়া-রাজ, এবং নগর-বিধ্বংসী প্রকল্প, তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। বার বার একেকটা ইমারত ভেঙ্গে পড়বে, মানুষের মৃত্যু-মিছিল দেখা দেবে, সকলে আপাত সজাগ হবেন, কিছুটা হৈচৈ হবে। কয়েকদিন সব শান্ত থাকবে। সব মিটে গেলে আবার, নীরবে মৃত্যুসজ্জা তৈরি হবে। আমরা কখনও দাবি তুলব না যে,

১) শহরের কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চল ব্যতিরেকে কোথাও হাইরাইজ তোলা যাবে না;

২) অন্তত ১৬ ফিট প্রশস্ত রাস্তা না হলে দোতলার বেশি তল তৈরির অনুমতি দেওয়া যাবে না;

৩) প্রোমোটার ‘সিসি’ না পাওয়া পর্যন্ত ফ্ল্যাট বিক্রি করতে পারবে না;

৪) জমি প্লট করে নতুন বসতি গড়ে তুলতে গেলে অন্তত ১৬ ফিটের রাস্তা থাকাটা বাধ্যতামূলক করতে হবে, নয়তো জমির মিউটেশন অথবা বাড়ির নকশা অনুমোদন পাবে না।

এটা বাস্তব, দেশভাগ ও ১৯৭১’এর যুদ্ধের কারণে এ রাজ্যে যে বিপন্ন মানুষের বিপুল আগমন, তার ফলে জনসংখ্যার আচম্বিত বিস্ফোরণে রুটি-রুজি সহ বাসস্থানের সমস্যার কারণে শহরতলির ওপর স্থানজনিত অত্যধিক চাপ পড়েছে। কিন্তু তার থেকে নিস্তারের উপায় অপরাধপ্রবণ প্রোমোটার-রাজ নয়, সুপরিকল্পিত নগরায়ন ও যথাযথ ইমারত-নীতি। এই সুবোধ চিন্তা কি আদৌ প্রশাসন ও রাজনৈতিক মহল থেকে আশা করতে পারি? 

  

Tuesday 12 March 2024

নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার হুমকি?

কোন ভয় থেকে সিএএ'র বিজ্ঞপ্তি জারি?

সোমনাথ গুহ



প্রায় পাঁচ বছর আগে ২০১৯-এর ১১ ডিসেম্বর ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন’ (সিএএ) সংসদে প্রণয়ন করা হয়। ছয় মাসের মধ্যে ওই আইনের নিয়মাবলী গঠিত হবার কথা ছিল। ইতিমধ্যে ওই আইনের প্রতিবাদে দেশ জুড়ে প্রবল আন্দোলন দেখা যায়, অন্তত একশো জন রাষ্ট্রের দমনপীড়নের শিকার হন। অসমে পাঁচ ছাত্র পুলিশের অত্যাচারে মারা যান। আইনের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে প্রায় দুশো পিটিশন জমা পড়ে। সরকার এর ফলে বারবার পিছু হটে, করোনার অজুহাত দিয়ে নিয়মাবলী গঠনের জন্য বারবার সময় চায়। অবশেষে ঠিক লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে, তারা একগুচ্ছ নিয়মাবলী ঘোষণা করে ১২ মার্চ থেকে সিএএ চালু করল। তাদের এই সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যেই  দেশের বিভিন্ন অংশে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। 

কেন এই সিএএ? নাগরিকত্ব সংক্রান্ত মূল সমস্যা শুরু হয় ২০০৩ সালে যখন আইনের একটি সংশোধনী অনুযায়ী জনসংখ্যাপঞ্জী (এনপিআর) এবং জাতীয় নাগরিকপঞ্জী (এনআরসি) প্রস্তুত করার সিদ্ধান্ত হয়। এই সংশোধনীর ১৪(এ) ধারা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকার চাইলে দেশ জুড়ে পঞ্জীকরণ চালু এবং প্রতিটি নাগরিকের ‘জাতীয় পরিচয়পত্র’ তৈরি করা বাধ্যতামূলক করতে পারে। এই সংশোধনীকে হাতিয়ার করে ২০১৬ সালে অসমে বিজেপি সরকার এনআরসি চালু করে। চূড়ান্ত এনআরসি থেকে উনিশ লক্ষ মানুষের নাম বাদ যায় যার মধ্যে প্রায় বারো লক্ষ ছিলেন হিন্দু। এটা বিজেপিকে হতচকিত করে। অসম বিজেপি পত্রপাঠ এই ফলাফল খারিজ করে দেয়। হিন্দু মানুষের নাম এনআরসি থেকে বাদ পড়ায় বিজেপির ভাবমূর্তি ধাক্কা খায়। এমনকি ২০১৯'এ পশ্চিমবঙ্গের তিনটে উপনির্বাচনেও এর প্রভাব পড়ে। মাত্র ছয় মাস আগে লোকসভা নির্বাচনে ঝড় তোলা সত্ত্বেও বিজেপি কিন্তু তিনটি কেন্দ্রেই হারে। কালিয়াগঞ্জ কেন্দ্রের ফল বিশেষ ভাবে ইঙ্গিতপূর্ণ, কেননা লোকসভায় এই কেন্দ্র থেকে তারা প্রায় ৫৬,০০০ ভোটে  এগিয়ে ছিল। ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে জেতা তখন বিজেপির ‘পাখির চোখ’। কিন্তু এনআরসি থেকে এত হিন্দুর নাম বাদ যাওয়ার কারণে বাংলায় হিন্দুদের মনে বিজেপি সম্পর্কে ঘোর সংশয় তৈরি হয়। উপরন্তু, মতুয়ারা আদৌ বিজেপিকে সমর্থন করবে কিনা তা নিয়েও আশঙ্কা  তৈরি হয়।

এই ক্ষতি সামাল দিতে বিজেপি তড়িঘড়ি বাজারে সিএএ নিয়ে আসে। শোনা যায়, অমিত শাহ'র বিখ্যাত উক্তি: 'আপ ক্রোনোলজি সমঝিয়ে'- প্রথমে সিএএ, তারপর এনআরসি। অর্থাৎ, সিএএ'র সুযোগ নিয়ে হিন্দুরা নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন এবং এনআরসি হয়ে দাঁড়াবে মুসলিম ছেঁকে তোলার কল। মতুয়া সম্প্রদায়ের একটা অংশ কেন্দ্রের শাসক দলের এই প্রতিশ্রুতিতে প্রভাবিত হন। নাগরিকত্বের কলা-মুলো ঝুলিয়ে বিজেপি ২০২১-এর বিধানসভা ভোটে ফয়দা তোলে- নদীয়া, উত্তর ২৪-পরগণা এবং উত্তর বাংলার কিছু অংশে এই সম্প্রদায় অধ্যুষিত প্রায় পনেরোটা আসনে তারা জয়লাভ করে। 

বিজেপি এবার লোকসভায় ৩৭০টি আসন জয়ের লক্ষ্য নিয়ে নেমেছে। এর জন্য অসমে ও পশ্চিমবাংলায় তারা আসন সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য মরীয়া। বাংলায় মতুয়া ভোটব্যাঙ্ক তাদের কাছে অপরিহার্য। তাই তারা 'নিঃশর্তে নাগরিকত্ব' নামক আরও একটি জুমলা সামনে নিয়ে এসেছে। সিএএ কি আদৌ নিঃশর্ত নাগরিকত্ব দেবে?  

এই আইনের ফলে ৩১শে ডিসেম্বর, ২০১৪ অবধি পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, পার্সি ও খ্রিশ্চান ধর্মের যে সব মানুষ ভারতে এসেছেন তাঁদের অবৈধ অভিবাসী হিসাবে গণ্য করা হবে না। মুসলিমরা এই আইনের সুযোগ পাবেন না, তাই এই আইন বৈষম্যমূলক। পাকিস্তান, আফগানিস্তানে শিয়া, হাজারা সম্প্রদায়ের মানুষরাও নির্যাতিত, তাঁরা কিন্তু ভারতে আশ্রয় পাবেন না। পার্শ্ববর্তী দেশ মায়ানমারের রোহিঙ্গারা, যাঁরা গণনিধনের শিকার হয়েছেন, তাঁদেরও এ দেশে ঠাঁই নেই। সঙ্ঘ পরিবারের যুক্তি, শ্রীলঙ্কার তামিলদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি কারণ তারা জাতিগত ভাবে নিপীড়িত, ধর্মীয় ভাবে নয়! নেপাল, ভুটানের নির্যাতিত মানুষেরাও এই আইনের সুযোগ পাবেন না। 

নাগরিকত্ব কি নিঃশর্তে পাওয়া যাবে? আদৌ নয়। আইনে যে বিষয়টি লক্ষণীয় তা হচ্ছে, এই ছটি ধর্মের যে মানুষরা আসছেন তাঁরা কিন্তু সরাসরি নাগরিকত্ব পাচ্ছেন না, তাঁরা শুধুমাত্র ‘অবৈধ অভিবাসী’ হিসাবে গণ্য হবেন না; তাঁদের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে হবে এবং তার জন্য কিছু শর্ত আছে। প্রথম শর্ত, ওই তিনটি দেশে ধর্মের কারণে নিপীড়িত ছটি ধর্মের মানুষেরাই কেবল এই আইনের সুযোগ পাবেন। দ্বিতীয় শর্ত, তাঁরা এই দেশে এসেছেন ২০১৪'র ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে। তৃতীয় শর্ত, এক বছর টানা ভারতে থেকেছেন এবং গত চোদ্দ বছরে অন্তত পাঁচ বছর এখানে থেকেছেন।

সিএএ'র জন্য ৩৯ পাতার যে নিয়মাবলী সরকার প্রকাশ করেছে সেটির প্রথম পাঁচ পাতা বিভিন্ন নিয়ম এবং বাকী নানা ধরনের ফর্ম। ধর্মীয় উৎপীড়নের কোনও প্রমাণ দিতে হবে কি না তা পরিষ্কার নয়। প্রথম ফর্মে নিজের সম্পর্কে তথ্য দিতে হবে। পিতামাতার নাম, কোন দেশ, কোন জেলা থেকে এসেছেন, কবে এসেছেন ইত্যাদি জানাতে হবে। সঠিক তথ্য জমা দিয়েছেন এই মর্মে একটি হলফনামা দিতে হবে। কোনও ভারতীয় নাগরিকের থেকে ‘ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট’ বা নিজের চরিত্র সম্পর্কে হলফনামা জমা দিতে হবে। আবেদনকারীকে অষ্টম তফসিলের যে কোনও একটি ভাষা বলতে জানতে হবে, সেটি সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকাও প্রয়োজন। তাঁর আবেদন যদি মঞ্জুর হয় তাহলে আগের দেশের নাগরিকত্ব ছাড়তে হবে এবং এই মর্মেও তাঁকে হলফনামা দিতে হবে। 

কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা নিয়োজিত দুটি কমিটি যাবতীয় তথ্য যাচাই করবে। আবেদন প্রথমে যাবে জেলা কমিটির কাছে। তাঁরা সব তথ্য খতিয়ে দেখে সন্তুষ্ট হলে সেই আবেদন উচ্চতর একটি বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত কমিটির কাছে পাঠাবে। দ্বিতীয় কমিটির দুই জন সদস্য, উভয়েই হবেন সরকারের উচ্চপদস্থ আধিকারিক। কোনও আবেদনকারী যদি সঠিক নথি জমা দিতে না পারেন তাহলে প্রথম কমিটি দ্বিতীয়কে সেটি খারিজ করার পরামর্শ দিতে পারে। সমস্ত নথি ঠিক থাকলে ডিজিটাল শংসাপত্র দেওয়া যেতে পারে। 

এর থেকে এটা পরিষ্কার যে, মোটেও নিঃশর্ত নাগরিকত্ব দেওয়া হচ্ছে না। এবার একটা বাস্তব পরিস্থিতি ভেবে দেখুন। ধরা যাক একজন হিন্দু মানুষ ২০০০ সালে বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবাংলায় এসেছেন। সীমান্তবর্তী কোনও ছোট শহরে বাড়ি ভাড়া করে তিনি একটা ব্যবসা শুরু করেছেন। প্রভাবশালী কাউকে ধরে নথিপত্র জোগাড় করেছেন। ছেলেমেয়ে স্কুলে পড়ছে। ভোটও দিয়েছেন এবং মোটামুটি থিতু হয়ে বসে তিনি একটা স্থায়ী জীবন শুরু করেছেন। এবার, কেন্দ্রীয় সরকারের এই নতুন আইন দ্বারা প্ররোচিত হয়ে তিনি সিএএ'র মাধ্যমে নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য আবেদন করলেন। এটা করা মাত্র যে মানুষটি স্থায়ী জীবন শুরু করেছিলেন তিনি কিন্তু নিজেকে অবৈধ ঘোষণা করলেন, নিজের অস্তিত্ব বিপন্ন করে ফেললেন। এরপর, তাঁর আবেদন যে মঞ্জুর হবে তার কী নিশ্চয়তা আছে? প্রতিটি ফর্ম, হলফনামা তাঁকে ঠিকঠাক পূরণ করতে হবে, সঠিক নথিপত্র জমা দিতে হবে এবং তারপরেও তাঁকে এই দুটি কমিটির কর্মদক্ষতা, ধর্মীয়, জাতিগত নিরপেক্ষতার ওপর নির্ভর করতে হবে। অসমের এনআরসি একটা বিরাট শিক্ষা! শুধুমাত্র নাম, পোশাক বা চেহারা ‘সন্দেহ’ উদ্রেক করার কারণে অনেক আবেদনকারীকে কাগজ নিয়ে বছরের পর বছর ঘুরতে হয়েছে।

বর্তমানে সিএএ সাব-জুডিস, সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন। সেদিক থেকে দেখলে প্রশ্ন উঠবে, সরকার কি আদৌ আদালতের রায়ের আগে এই আইনের নিয়মাবলী গঠন করতে পারে? এছাড়া এই আইন সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারা লঙ্ঘন করে, ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব প্রদান করে ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শকে অস্বীকার করে। কিন্তু এই সরকার তো সংবিধান বা বিচারব্যবস্থাকে মান্যতা দেয় না। 

রমজান শুরুর পরের দিন নিয়মাবলী ঘোষণা করা হয়েছে যাতে মুসলিম জনতা প্রতিবাদ করতে দ্বিধা বোধ করেন। ‘ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লিগ’ আজ সুপ্রিম কোর্টে এই আইন ও এর নিয়মাবলীর ওপর স্থগিতাদেশের জন্য আবেদন জানিয়েছে। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা বিক্ষোভ দেখিয়েছেন এবং তাঁদের নির্মম ভাবে দমন করা হয়েছে। অসমে এনআরসি করা হয়েছিল ২৪শে মার্চ, ১৯৭১'কে কাট-অফ ডেট ধরে; সেটা নতুন আইনের কারণে হয়ে দাঁড়াল ৩১শে ডিসেম্বর, ২০১৪। মানুষ সেখানে রাস্তায় নেমে পড়েছে, বিরোধী দলগুলি বনধ ডেকেছে। কলকাতা এবং বিহার ও ঝাড়খন্ডের শহরে বিক্ষোভ প্রদর্শন হয়েছে। নির্বাচনী বন্ডের জালিয়াতি, নির্বাচন কমিশনারের পদত্যাগ, দিল্লিতে নামাজিদের ওপর অভূতপূর্ব আক্রমণ এবং এখন সিএএ'কে আবার ঠাণ্ডা ঘর থেকে তুলে আনা- এসব মিলে মো-শা সরকার দেশ জুড়ে এক তুমুল অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। 

প্রশ্ন উঠছে, শাসক এত মরীয়া কেন? তারা কি বিপন্ন, বিপর্যস্ত বোধ করছে?


Tuesday 5 March 2024

তথ্য নিছক তথ্য নয়

জিডিপি'র ফাঁকি ও গরিবি কমার গপ্পো

দীপঙ্কর দে



জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপি বৃদ্ধির হার নিয়ে প্রায়শই নানা তথ্য কানে আসে। কখনও বিতর্কও বাঁধে অর্থশাস্ত্রের পণ্ডিতদের মধ্যে। অবশ্য গড়পড়তা নাগরিকের জীবনযাপনে স্রেফ জিডিপি বৃদ্ধির হারে কোনও তফাত হয় না। জিডিপি বৃদ্ধি হলেও ক্ষেত্র বিশেষে নাগরিকের আর্থিক সংকোচন হতে পারে। যেমন ধরুন, বর্তমান অর্থবর্ষের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে (অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর) ভারতের জিডিপি বেড়েছে ৮.৪ শতাংশ হারে, কিন্তু একই সময়ে কৃষি ক্ষেত্রে উৎপাদন সংকুচিত হয়েছে। তাই অনুমান করাই যায়, কৃষি ক্ষেত্রে যুক্ত ভারতের বিশাল সংখ্যক নাগরিকের আর্থিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। মোদ্দা কথা, জিডিপি বাড়লেই হবে না, জাতীয় উৎপাদনের বন্টন সুষম হতে হবে। নইলে ভারতের মতো রাষ্ট্রে যেখানে সম্পদ ও আয়ের বৈষম্য দিন দিন বাড়তে বাড়তে খুব কুৎসিত রূপ নিয়েছে, সেখানে জিডিপি বাড়লে শ্রেণি বৈষম্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা আরও বাড়ে। 

জিডিপি নিয়ে এই নিবন্ধের আলোচনা একটু খটমটে। অন্য সময় এ আলোচনা না করলেও চলত। আম নাগরিকের কী বা যায় আসে যদি সরকার জিডিপি বৃদ্ধির হার বাড়িয়ে বা দেশের গরিবের সংখ্যা কমিয়ে বলে। মিথ্যে পরিসংখ্যানে বাস্তব অবস্থার পরিবর্তন হয় না। রাজনৈতিক চাপানউতোর বাড়ে। তবে মিথ্যের জোরে অপদার্থ শাসকের পক্ষে সহমত নির্মাণ সহজ হয়। নির্বাচনের মরসুমে রাষ্ট্রের তথ্যকে যাচাই করা তাই খুব জরুরি।

সমস্যা শুরু গত সপ্তাহে, যেদিন ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিকাল অফিস (NSO ) ঘোষণা করে যে বর্তমান অর্থবর্ষের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে ভারতের জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল ৮.৪ শতাংশ। হঠাৎ এই বৃদ্ধির হার. রিজার্ভ ব্যাংকের বৃদ্ধির আগাম হিসেবের (৬.৫ শতাংশ) থেকে অনেকটাই বেশি। দেশের সংসদীয় নির্বাচনের মুখে এই বৃদ্ধির ফলে বর্তমান অর্থবর্ষে জিডিপি বৃদ্ধির আনুমানিক হার ৭.৩ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৭.৬ শতাংশে। স্বভাবতই এই তথ্য শাসক দলের সাফল্য বলে প্রচারিত হতে থাকে। 

অর্থনীতির পণ্ডিতেরা সন্দিহান হন দুটি কারণে: ক) রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সহ বিশ্ব ব্যাঙ্ক বা আইএমএফ'ও এতটা বৃদ্ধির আগাম অনুমান করেনি; খ) উক্ত সময়ে দেশের গ্রস ভ্যালু অ্যাডেড (GVA) পরিসংখ্যানের সঙ্গে জিডিপি পরিসংখ্যানের অমিল খুব বেশি। ওই ত্রৈমাসিকে ভারতের জিভিএ বৃদ্ধির হার ৬.৫ শতাংশ, যার অর্থ, জিডিপি ও জিভিএ বৃদ্ধির হারের তফাত ১৯০ বেসিস পয়েন্ট যা গত দশ বছরে সর্বাধিক। তাই শুরু হল কাটাছেঁড়া।

নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, আমরা অনেক পণ্য কিনি যার প্যাকেটে লেখা থাকে 'কর সমেত সর্বোচ্চ মূল্য'। আমরা কিন্তু পণ্যের প্রকৃত মূল্য কত তা নিয়ে মাথা ঘামাই না। ঘামালে দেখব, পণ্যের বিক্রয়মূল্য = পণ্যের প্রকৃত মূল্য + অপ্রত্যক্ষ কর - অনুদান। একই ভাবে যদি এবার জাতীয় উৎপাদনের কথা ভাবি তবে দাঁড়ায়: জিডিপি = জিভিএ + অপ্রত্যক্ষ কর -অনুদান।

বোঝা যাচ্ছে, তৃতীয় ত্রৈমাসিক জিডিপি বৃদ্ধির হার আর জিভিএ বৃদ্ধির হারের যে তফাত'টা হচ্ছে তার কারণ: ১) অপ্রত্যক্ষ কর বৃদ্ধি ও ২) অনুদান হ্রাস। কর বৃদ্ধি ও অনুদান হ্রাস পেলে নাগরিকের ক্রয়ক্ষমতা কমে। তাই বলা যেতেই পারে, ৮.৪ শতাংশ জিডিপি বৃদ্ধি পেয়েছে অপ্রত্যক্ষ কর বাড়িয়ে ও অনুদান কমিয়ে। যার ফলে জিডিপি বাড়লেও আম নাগরিকের আর্থিক দুরবস্থা বেড়েছে। অবশ্য সরকারি তথ্যও সে কথা বলছে। বর্তমান আর্থিক বছরে জিএসটি খাতে রাজস্ব আদায় বেড়েছে ১২.৫ শতাংশ। আর খাদ্য ও সারে সরকারের যে অনুদান দেওয়ার কথা, তার মাত্র ৭০-৭৫ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে। তাই অঙ্কের নিয়মেই জিডিপি ও জিভিএ তথ্যে এত গরমিল চোখে পড়ছে। আর সরকার পোষিত মিডিয়া ও কতিপয় অর্থশাস্ত্রী জিডিপি বৃদ্ধির মূল কারণ লুকিয়ে সরকারের জয়গান গাইছে। 

শুধু জিডিপি বৃদ্ধির তথ্যই নয়, দেশের গরিবি মোচনের হার নিয়েও ব্যাপক কারচুপি করছে সরকার। গত সপ্তাহে বহু বছর পর ন্যাশনল স্যাম্পল সার্ভে অফিস (NSSO ) Household Consumption Expenditure Survey ( HCES ) ২০২২-২৩'এর আংশিক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তার ভিত্তিতে নীতি আয়োগের কর্তা দাবি করেছেন, বর্তমানে দরিদ্র নাগরিকের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ৫ শতাংশ। অর্থাৎ, ২০১১-১২ সালের সর্বশেষ HCEC তথ্যের নিরিখে দরিদ্র মানুষের অনুপাত কমেছে প্রায় ১৭ শতাংশ। কারণ, ২০১১-১২ সালে সুরেশ তেন্ডুলকরের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি  HCEC তথ্যের ভিত্তিতে হিসেব করে বলেছিল, ভারতের মোট জনসংখ্যার ২১.৯ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। এ ক্ষেত্রেও বিশেষজ্ঞ অর্থশাস্ত্রীরা সরকারি হিসেবে কয়েকটি গুরুতর ত্রুটির কথা উল্লেখ করেছেন। (টেলিগ্রাফ অনলাইন ২ মার্চ ২০২৪)।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন: 

১) ২০১১-১২ সালে তেন্ডুলকার যে পদ্ধতিতে দরিদ্রের সংখ্যা অনুমান করেছিলেন, সেই একই পদ্ধতি ২০২২-২৩ সালে ব্যবহার করা যাবে না। কারণ, আগেরবার HCES তথ্য সংগৃহীত হয়েছিল মিক্সড রেফারেন্স পিরিয়ড (MRP ) পদ্ধতিতে; কিন্তু নতুন HCES'এর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে মডিফাইড মিক্সড রেফারেন্স পিরিয়ড (MMRP) পদ্ধতি। তাই, এ ক্ষেত্রে ভিন্ন পদ্ধতিতে হিসেব করতে হবে। কমলা ও আপেলের তুলনা সম্ভব নয়। দুটোই ফল হলেও ভিন্ন জাতের ফল।

২) ২০১১-১২'এর সমীক্ষায় পারিবারিক খরচের হদিস পেতে ৩৪৭টি পণ্য ও পরিষেবার তথ্য তালাশ করা হয়েছিল। কিন্তু ২০২২-২৩'এ সে সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়ায় ৪০৫টি পণ্য ও পরিষেবায়। স্বাভাবিক ভাবেই এ ক্ষেত্রে পারিবারিক খরচের পরিমাণ আগের তুলনায় বেশি হওয়ার কথা।

৩) অর্থনীতিবিদ সন্তোষ মেহরোত্রা হিসেব কষে দেখেছেন, ২০২৬ সালের পর দেশের ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে অবনতির ফলে প্রায় ছয় কোটি মানুষ কৃষি ক্ষেত্রে ফেরত যান। এঁদের প্রায় পাঁচ কোটি নিজেদের পারিবারিক কৃষিতে বিনা পারিশ্রমিকে যুক্ত হন, যদিও সরকারি পরিসংখ্যানে তাদের কর্মরত শ্রমিক বলেই নথিভুক্ত করা আছে। স্বাভাবিক ভাবেই অনুমান করা যায়, এই ছয় কোটি নাগরিকের আর্থিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, ২০২২-২৩'এর আর্থিক সমীক্ষাতেও স্বীকার করা হয়েছে, মুদ্রাস্ফীতির ফলে ভারতে প্রকৃত মজুরি কমেছে।

সরকারি পরিসংখ্যান যাই বলুক, মুষ্টিমেয় ধনী ও উচ্চবিত্ত ছাড়া ভারতের আম নাগরিক প্রতিদিন টের পাচ্ছেন বাস্তব পরিস্থিতি কী। সরকারি পরিসংখ্যানে নাগরিকের আস্থা দিন দিন তলানিতে এসে ঠেকেছে। মিথ্যে পরিসংখ্যানে আর চিড়ে ভিজবে না। এটাই ভরসা।