Wednesday 10 February 2016

বই আলোচনা

পলিটিক্স পেলে অবশ্যই পড়বেন

রজত চৌধুরীর ছোটগল্প সংকলন ক্যালকুলাস’ , গাংচিল


আশিস চট্টোপাধ্যায়


সবাই কি দিবাস্বপ্ন দেখে? তাতেই বিভোর হয়ে থাকে কিছুক্ষণ? এমন কি কোনও কথা আছে আছে যে লাথি-ঝাঁটা খাওয়া ভাঙাচোরা মানুষেরাই জাগা স্বপ্নে বিভোর হয় বেশি? জানি না বাবা। কিন্তু এটা জানি, ঠিক দপুর বেলা, সময় যখন থমকে থাকে, কাছে-দূরে নানা আওয়াজের মাঝেও জেগে জেগেই স্বপ্নে ডুব দিতে বেশ লাগে। বাহ্যিক শব্দ-টব্দ কমে আসে, ডুব দেওয়া যায় রূপসাগরে। লেখক কী ভেবে লিখেছেন জানি না, কিন্তু রজত চৌধুরীর ‘ক্যালকুলাস’ ওঁর ইংরেজি উপন্যাসগুলো পরে কখন আলোচনা করা যাবে। পড়তে পড়তে কেন যেন মনে হল, অসম্ভব আর সম্ভবের মাঝামাঝি একটা প্রতীকী অস্বিত্বে ঢুকে পড়েছি। বেশ লাগছে। 
সাতটি লেখা। সবক’টিই ফিকশন। প্রথমটা, যেখানে কুলাস নামের প্রাণীদের সঙ্গে বহির্জগতের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেটা অনেকটা ভূমিকার মতো। আমি কিন্তু এটাকেও ফিকসন বলছি। কুলাসরা অটোরিক্সা চালাতে চালাতে সংস্কৃতে কথা বলছে, এরকম একটা শুভদিনের কথা কোন ক্যাল-বাসী না ভাবে। যত ভাবে, তত, যাকে বলে কঠোর বাস্তবে, অটো-কুলাসদের ভাষায় বিন্যাস সংস্কৃত থেকে দূরে চলে যায়, আরও আরও দূরে। দারুণ দিবাস্বপ্ন, কিন্তু যা-ই বলেন। শুধু এটাই কুলাসদের পরিচয় নয়, আরও আছে। তবে যেহেতু এটাও একটা গল্পই বটে, তাই আর না ভাঙাই ভাল। 
দু-পাতার ক্যালকুলাসের কাচ্চাবাচ্চা ছাড়াও রয়েছে কয়েকটি গল্প। একটা বেশ বড় গল্প। যেটাকে ছোট উপন্যাসও বলা যায়। প্রথম গল্প ‘পুঁচকে বাবার শেষ কেরামতি’তে কেমন তুকতাক করে খারাপ দিন এক লাফে টপকে পার হওয়া যায়, কী কী তার কায়দা-কানুন, কেমন করে গুপ্ত বিদ্যায় ভর করে জয় করা যায় আচ্ছে দিন, তার উপাখ্যান। বেশ লাগে। যেন আমাদেরই গোপন রাগ মেটাবার কোনও সুপ্ত ইচ্ছার ইচ্ছামতীতে নৌকো বাওয়া।
ছকু খানসামা লেনের ‘পারভিন’ গল্পটি আবার অন্য স্বাদের। জীবনের যে সময়টায় নারীসঙ্গ পাবার উত্তাল চাহিদা আচ্ছন্ন করে রাখে, সেই সময়ের গল্প। নারীকন্ঠ, নারীদেহ, তার স্পর্শ, আরও আরও গভীরে যাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। কত মেয়েরই তো প্রেমে ভেসে যায় ছেলেরা। কিন্তু কাছে যাওয়া যায় কি? যদি দূরে দূরে সরে সরে যায় সেই নারী, যাকে আমরা চাই, তখনই ঢুকে পড়ে ম্যাজিক। জাদুর নরম আছন্নতায় তাকে পাওয়া যায়, অন্তরঙ্গতায়, তবু পাওয়া যায় কি? ফ্যান্টাসিতে ভেলা ভাসানোর এক অন্য স্বাদের গল্প এটি। একটা রেশ জেগে থাকে। 
‘আশা মশলা ভান্ডার’ ডিটেকটিভের গল্প। ডিটেকটিভগিরি করার বাঙালী অনুপ্রেরণা। কিন্তু এখানে প্রচলিত ধারণা যে উল্টে যায়। চোর আসে ডিটেকটিভের কাছে, আশ্রয়ের জন্য, পেয়েও যায়। আর এখানে শুরু আসল টানাপোড়েন। চোরেরা কিন্তু চুরি করছে না। জিনিসপত্র সরাচ্ছে অন্য কোনও বৃহত্তর গন্ধ, স্বাদ। তাহলে গোয়েন্দা কী করবে? চোর যদি রোগের লক্ষণ হয়, ওইসব গন্ধ, স্বাদ হল ব্যাকটেরিয়া। ব্যাকটেরিয়ার সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে এক জাদু বাস্তবতায় ঢুকে পড়ে গোয়েন্দা প্রবর। বেশ বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে শেষপর্যন্ত বিস্ফোরণে উড়ে যায় রোগ-জীবানুর ঘাঁটি। সমাজ কলুষমুক্ত হয়। এভাবে সমাজ শোধন কে না চায়? নাটকীয় সংঘর্ষের এই গায়ে কাঁটা দেওয়া ন্যারেটিভে পলিটিক্সটিও আর নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারে না। আমরা যারা ছোট ছোট চোর, বেইমান, বিশ্বাসভঙ্গকারী, তাদের পেছনে রয়ে যায় বিরাট এক আসল কারণ। সেই কারণ-বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধা যায় কি? যখন যায় না, কল্পনাতেই না হয় সেটা করা গেল। ভাল গল্প।
‘অটো’ গল্পে ধরা আছে নগরায়নের দাম চোকানোর এক মর্মস্পর্শী কাহিনী। নতুন শহরে রেলপথ অটো-চালকদের জীবিকা কেড়ে নেয়। নগর হয়ে ওঠে বিশ্বমানের মহানগর। যে মহানগর উন্নয়নের পথে রেখে যায় সেই শহরের অটো-চালকদের লাশ, সেই শহরের কথা বলতে গিয়ে লেখক জানাচ্ছেন, লাশের ‘গলায় স্টিলের ব্লেডের মতো নেকলেসটা কৃত্রিম আলোয় হঠাৎ চকচক করে ওঠে – যেন কোনও বিপদ সংকেত দেখিয়ে দিয়ে যায় দুনিয়াকে।’ 
‘লেখক ভ্যানিশ’ও গোয়েন্দাগিরির গল্প। তবে অনেক বড় গল্প। এটাকে ছোট উপন্যাসও বলা যায়। এখানে লেখকেরা উধাও হয়ে যান। আর তাঁদের খোঁজার দায়িত্ব পড়ে গোয়ান্দাদের ওপর। পরে অবশ্য এক অদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেই লেখককে পাওয়া যায়, যেখানে লেখক আর লেখক থাকে না, হয়ে যায় লেখা-মজুর। বাজার, কাটতি আর টাকার ত্রিশূল খুঁচিয়ে মারে সৃষ্টির আনন্দকে। এ যদি পলিটিক্স না হয়, তো কোনটা? কিন্তু গোয়েন্দা গল্পের আঙ্গিকটা বেশ চমৎকারভাবে এগোয়। টান টান উত্তেজনা। পড়তে শুরু করলে শেষ না করে ওঠা যায় না। 
‘বকধার্মিক’ এই বইয়ের শেষ গল্প। এখানে বরং কথাবার্তা বেশ সোজাসাপটা। আগ্রাসী বিজ্ঞাপন আর বিপণনের প্রবল হাওয়ায় সমাজের বিপন্নতার গল্প। বেশ লাগে। 
ফিরে যায় ক্যালকুলাসের কাচ্চাবাচ্চায়। কেন জানি না, লেখক লিখেছেন, ‘কিন্তু কোনও পলিটিক্স করবেন না প্লিজ। বইটা পড়ে যাদের পলিটিক্স পাবে তারা দয়া করে হাকলবেরী ফিনের শুরুতে মার্ক টোয়েনের ঘোষণাটা দেখে নেবেন।’
আমার কিন্তু অন্য রকম মনে হল। আমার মনে হল গল্পগুলো পলিটিক্সের। সাহিত্যে পলিটিক্সের পুরনো ফর্ম ভেঙে ম্যাজিক রিয়েলিটির নতুন আঙ্গিক গড়েছেন লেখক। অচিরেই যা নতুন ট্রেন্ড হতে পারে।

No comments:

Post a Comment