Monday 26 September 2016

অন্য চোখে আমজনতা ও মিডিয়া



আমজনতা ও মিডিয়া - এই দুই শব্দবন্ধ থেকে মুক্তি চাই
পার্থ সেনগুপ্ত 
 
কিছু উদাহারণ দিয়ে শুরু করি।

এক - পপুলার বাণিজ্যিক ছায়াছবিতে দেখেছি নায়কের প্ররোচণায় একদল মানুষ খলনায়কের দিকে তেড়ে যাচ্ছে তাকে মারবে বলে প্রায়শই, এই ধরনের ছবিতে ‘আমজনতা’ নামক এক মেরুদণ্ডহীন নির্বোধ ভিড়ের নির্মাণ করা হয়

দুই - অন্য দিকে, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যুগে, Big Data বিশ্লেষণের মাধ্যমে কর্পোরেট দুনিয়া একেবারে নির্দিষ্ট উপভোক্তার কাছে পৌঁছে যেতে চাইছে কর্পোরেট দুনিয়া ক্রমশ ভিড়ে বিশ্বাস করতে চাইছে না, ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে সমাজকে ছোট ছোট ভাগে দেখতে চাইছে

তিন - ‘Nation wants to know’ কথাটা ব্যবহার করে একজন সঞ্চালক তাঁর নিজের কথা মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দেন জনসমষ্টি একটা সুবিধেজনক শব্দ এর সাহায্যে একজন মানুষ বা গোষ্ঠী তার ধ্যান ধারণা, বক্তব্য, আদর্শের টোটকা, আদেশ ইত্যাদি জনসমষ্টিকে জড় পদার্থ জ্ঞানে তার ওপর বিমূর্তভাবে আরোপ করতে পারে

এই উদাহরণগুলো দেওয়ার কারণ হল, সকল স্তরের ক্ষমতাশালী মানুষ তাদের স্বার্থ অনুসারে ভিড় ও বিভাজন দুটোই সৃষ্টি ও ব্যবহার করে এক বিমূর্তবিচ্ছিন্ন অন্যকে নির্মাণ করে তাকে শোষণ করা ও প্রয়োজনে তোষণ করা বিভাজিত সমাজের মূল নিদর্শন রাজনৈতিক শব্দ হিসাবে ‘আমজনতা’ সেই বিমূর্তবিচ্ছিন্ন অন্যর রূপান্তর মাত্র

রাজনীতির আঙ্গিনায় ‘আমজনতা’ জনসাধারণ শব্দের নিরীহ অনুবাদ নয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা ‘আমজনতা’ শব্দের ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজকে রাজনৈতিক ভোক্তার সমষ্টিতে পরিবর্তন করে কৃত্রিম ভাবে তৈরি অভাব ও চাহিদা কিঞ্চিৎ পূরণের দ্বারা সৃষ্ট উন্নতির ও উদ্ধারের জন্য চির-অপেক্ষামান ‘আমজনতা’ রাজনীতির একান্ত প্রয়োজনীয় বস্তু রাজনৈতিক ব্যবস্থা ‘আমজনতা’ সৃষ্টির মাধ্যমে নিজেদের পেছনে যতটা সম্ভব বড় ভিড় জমা করতে চায় এই কারণেই পরিচিতি, পপুলিজম ও পাইয়ে দেওয়া ইত্যাদি রাজনীতির প্রধান হাতিয়ার মানুষকে নয়, রাজনীতির শুধুমাত্র ‘আমজনতা’ নামক ভিড়টার প্রয়োজন রাজনীতি ‘আমজনতা’ নামে এক homogeneous বস্তু সৃষ্টি করতে চায় দিল্লিতে আম দল শ্রেণি নির্বিশেষে জল ও বিদ্যুতের মাশুল কমানোর কারণে, শ্রেণি নির্বিশেষে সবাই পকেটের কথা ভেবে ‘আমজনতা’ হয়ে গেল ‘আমজনতা’ ও ভোট-ব্যাঙ্ক এক বস্তু নয় রাজনৈতিক ভোক্তাকে আবার পার্টির স্বার্থ অনুসারে বিভাজন করা হয় পার্টিগত ভক্তির সাহায্যে রাজনীতি মানুষকে ক্রমে বশীভূত পুতুলে পরিণত করতে চায়

এক দিকে মানুষের বিভিন্নতা যেমন আছে, মানুষের জীবনযাত্রায়, চাহিদায় বিস্তর রকমফের আছে, তেমনই  আবার কোনও স্তরের মানুষই নিজেকে আমজনতা ভাবতে রাজি নয় জাতি, বর্ণ, শ্রেণি, ভাষা, অঞ্চল আরও যে কত কারণে মানুষ নিজেকে অন্যের থেকে আলাদা বা উন্নত ভাবতে ভালবাসে তার শেষ নেই সুতরাং, ‘আমজনতা’ কে, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে নিতান্ত গৃহহীনদের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, তাদের মধ্যে পর্যন্ত কী ধরনের ভয়ঙ্কর ভেদাভেদ বোধ অফিসে, কারখানায়, নির্মাণ ক্ষেত্রে সর্বত্র দেখতে পাই, মানুষে মানুষে কী ধরনের ভেদাভেদ জাতির ভিত্তিতে, লিঙ্গের ভিত্তিতে, ভাষার ভিত্তিতে, ধর্মের ভিত্তিতে, রঙের ভিত্তিতে, দেশ-স্থানের ভিত্তিতে মানুষ মানুষকে হেনস্তা করে, লাঞ্ছিত করে এমনকি নির্যাতন করে যা অত্যন্ত লজ্জাজনক ও নিন্দনীয় বিশেষ করে নারী সমাজ, উত্তরপূর্ব ভারত থেকে আসা মানুষ, আফ্রিকার মানুষ ও অন্যান্য বাহিরাগতদের হেনস্তার শেষ নেই এই অকথ্য ব্যবহার সব শ্রেণির মানুষের কাছেই পাওয়া যায় এই ব্যবহারের কোনও শ্রেণি বিভেদ নেই এখানে আমজনতা কে বা কোথায়? আজ ইংল্যান্ডে ব্রিক্সিট’এর পর শ্বেতাঙ্গ শ্বেতাঙ্গকে আক্রমণ করছে শারীরিক হেনস্থা হয়তো অল্পসংখ্যক মানুষ করে, কিন্তু রাজনীতি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ও সামাজিক ভাবে প্রকল্পিতঅন্যেরপ্রতি অহেতুক ঘৃণা বোধ ‘আমজনতা’র প্রধান বৈশিষ্ট্য মানুষ নিজেকে পাঁচজনের সাথে সমান স্তরে এনে নিজেকে আমজনতা মনে করে না, ভাবতে রাজি নয় এই পরিস্থিতিতে ‘আমজনতা’ শব্দটা এই মানুষগুলোর ওপর বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া একটা রাজনৈতিক তকমা মাত্র

তবে মানুষ নিজেকে ‘আমজনতা’ হিসেবেও কখনও কখনও দেখতে চায় তা শুধু মাত্র দুটো ক্ষেত্রেই দেখতে চায় এক, যখন পকেটে টান পড়ে জিনিসের দাম বাড়লে অথবা কর বাড়লে ‘আমজনতা’ শব্দের ব্যবহার দেখতে পাই তখনই সে ‘আমজনতা’ হয়ে যায় আর সরকারকে দোষারোপ করে ‘আমজনতা’র কথা ভাবছে না বলে দুই, যখন শাশুড়ি-বউ’এর ঝগড়া, বিগ বসের কোন্দল, ক্রাইম’এর নামে কেচ্ছা নিয়ে ব্যস্ত মানুষকে একটু গভীর ভাবে ভাবতে বলা হয়, তখন সে ‘আমজনতা’ হয়ে যায় সে বলে, আমি তো ‘আমজনতা’, অত কী আর বুঝি?

যেমন, লিটল ম্যাগ কি ‘আমজনতা’ পড়ে? লিটল ম্যাগ’এর এক নির্দিষ্ট জনতা আছে খুবই সীমিত সংখ্যক মানুষ পড়ে এই সীমিত সংখ্যক মানুষদের ‘আমজনতা’ অর্থাৎ কিনা ছাপোষা মানুষেরা, যাদের আন্থেম হলতুমি আর আমি আর আমাদের সন্তান/এই আমাদের পৃথিবীআঁতেল আখ্যা দিয়ে থাকে এই ‘আমজনতা’ নিজেদের এবং পরিবারের স্বার্থের বাইরে কিছুই ভাবে না ভাবতে বা জানতে চায় না নিজের মাথায় ‘আমজনতা’ কথাটা সুবিধে মতো বসিয়ে নিলে আর ‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া’ এই চাপটা নিতে হয় না ‘আমজনতা’ শব্দটা হল সমাজবোধের ঝুট ঝামেলার রক্ষাকবচ কে মরল, কে বাঁচল, কী দরকার বাবা, আমি তো ‘আমজনতা’ ‘আমজনতা’কে অন্যের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়তে সচরাচর দেখা যায় না ‘আমজনতা’ নেহাত স্বার্থে ঘা না পড়লে সচরাচর প্রতিবাদ করে না নিজের স্বার্থের সাথে অন্যের স্বার্থ মিলে গেলে তখন দল বাঁধে অন্যের কথা ভেবে পথে নামা তাদের ধর্ম নয়, তবে যদি রাজনৈতিক আদেশ বা আশীর্বাদ থাকে তবে অন্য কথা সুতরাং, আবার দেখছি ‘আমজনতা’ জনসাধারণ শব্দের নিরীহ অনুবাদ নয়, স্বার্থকেন্দ্রিক মানুষদের জন্য গা বাঁচানোর মুখোশ মাত্র

অথচ, যখন কিছু মানুষ দাবি-দাওয়া নিয়ে পথে নামে, ‘আমজনতা’ তাতে খুব বিরক্ত হয়, পথ অবরোধের কারণে ট্র্যাফিক জাম হলে, কাজের বা সাধারণ জীবন যাপনে বিঘ্ন ঘটলে তাদের বিরক্তির শেষ থাকে না তারা ভাবে এই নাটকটা কবে বন্ধ হবে মজার বিষয়, অবস্থার চাপে এই ‘আমজনতা’র একটা অংশ কখনও প্রতিবাদ করলে বা পথে নামলে সে ‘আমজনতা’র জন্য অপাংক্তেয় হয়ে যায় এক ভাবে ‘আমজনতা’ নিজেই নিজের বিরোধী কারণ আন্তরিক ভাবে তাঁরা কেউই আমজনতা নয়

‘আমজনতা’ এক অনুগ্রাহী শব্দ আমরা ‘আমজনতা’ শব্দটাকে অসহায়, নিরীহ ও প্রতারিত শব্দের সমার্থ শব্দ ধরে নিয়েছি শোষক ও শোষিতের মেরুকরণ আমাদের এই ধরনের ভাবতে বাধ্য করে ‘আমজনতা’র অর্থ কি শুধু ক্ষমতা ও প্রাচুর্য থেকে বঞ্চনা? আমরা ভুলে যাই, অধিকাংশ ক্ষেত্রে যে শোষক সেই আবার শোষিত বা বিপরীত গত শতকে যে মেরুকরণ আমরা দেখতে পাই, সে তুলনায় এই সময়ে উত্তর-নয়া উদারবাদের যুগে সমাজ অনেক বেশি জটিল হয়েছে বাজার অর্থনীতির কল্যাণে মানুষ সামাজিক-জনতা থেকে আত্মকেন্দ্রিক ভোক্তা-জনতায় পরিবর্তিত হয়েছে প্রতিযোগিতার অর্থনীতি ও বিভাজনের সামাজিক পরিবেশ মানুষকে স্বার্থ ও অহঙ্কারসর্বস্ব করে তুলেছে অত্যন্ত ছেঁদো বিষয় নিয়ে মানুষ অহঙ্কারের সুযোগ খোঁজে ও অন্যকে হেয় করে সুতরাং, বাস্তবিক রূপে কোনও ‘আমজনতা’ অবস্থা ও ব্যবস্থার খুব একটা পরিবর্তন চায় না উন্নতিবাদের বিস্তর সমালোচনা থাকা সত্তেও ‘আমজনতা’ শুধু স্বার্থ ও পকেট-সহায়ক পরিবর্তন চায়, সুবিধাবাদের পরিবর্তন চায়, সংবেদনশীলতা, সহমর্মিতার পরিবর্তন চায় না কী পাইনি তার হিসেব সে সারাক্ষণ মিলিয়ে চলেছে কী দিলাম সে ভাবনা তার মাথায় কখনই আসে না

‘আমজনতা’ কি সচেতন? সচেতনতার অর্থ যদি নিজের স্বার্থ অনুসারে দাবি-দাওয়ার ব্যাপারে সচেতনতা, তবে ‘আমজনতা’ অবশ্যই সচেতন তাকে যারা নির্বোধ মনে করে তারা খুব ভুল কাজ করে তবে অন্যের প্রতি দরদ, সহানুভূতি, মানবিকতাবোধ ইত্যাদি যদি সচেতনতার সংজ্ঞা হয়, তবে সে বিষয়ে বিপুল সংশয় রয়েছে বইকি!‘আমজনতা’র এই রূপ আমরা সব শ্রেণি, জাতি, ধর্ম ও সমাজে দেখতে পাই রাজনীতি এক চির-অভাবী, চির-ক্ষুধার্ত, চির-নির্ভরশীল ‘আমজনতা’ দেখতে চায় তাদের দাবি দাওয়া মাঝে মাঝে অল্প-স্বল্প মিটিয়ে রাজনীতি নামক প্রতিষ্ঠান তার প্রাধান্য বজায় রাখে রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো তার অনুরুক্ত ও ভক্তকুলকে প্রশ্রয়ের মাধ্যমে তার অস্তিত্ব বজায় রাখে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবে নির্মিত ‘আমজনতা’র ভুমিকা বহু সংখ্যক মানুষ সুবিধা বুঝে, নিজের স্বার্থ বুঝে পালন করে যায়



সমস্যা হল, মিডিয়া শব্দটা নিয়েও মিডিয়ার উদ্দেশ্য হল প্রচার আলাপ-আলোচনা ও প্রচার সম্পূর্ণ বিপরিতধর্মী দুটো ব্যবস্থা মিডিয়া একটা বাণিজ্যিক ব্যবস্থা, সে কথা ভুলে গেলে চলবে না। বাজার, শেয়ার, মুনাফা ও TRP, এগুলোই মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে এখানে মিডিয়া অর্থে প্রিন্ট ও টেলিভিশন মিডিয়ার কথা বলছি সে ক্ষেত্রে নীতি ও নৈতিকতার কোনও জায়গা নেই এক তরফা এই প্রচারধর্মী ব্যবস্থার ফলে আলাপ-আলোচনার মানসিকতা বিঘ্নিত হয় মানুষ হাঁ করে দেখতে বা শুনতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাও আমাদের ভাবনা-চিন্তা করতে, মত বিনিময় করতে শেখায় না যার ফলে আমরা কোনও আলাপ আলোচনা করতে অভ্যস্ত নই এছাড়াও, পুরুষতান্ত্রিক ও অসাম্য সমাজব্যবস্থার কারণে আদেশ ও অনুজ্ঞায় আমরা বেশি অভ্যস্ত মিডিয়া এই আদেশ ও অনুজ্ঞার ওপর দাঁড়িয়ে আছে

সোশাল মিডিয়াও খুব সূক্ষ্মভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় আমরা আপাত ভাবে মনে করি সোশাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রিত নয়, কিন্তু সে কথা ঠিক নয় এ কথা নতুন নয়, বহু মানুষ খুবই সীমিত ভাবে সোশাল মিডিয়া ব্যবহার করেন, নিয়ন্ত্রণের এই উপদ্রব থেকে বাঁচার জন্য যারা গুগল সার্চ ইঞ্জিন নিয়ে গবেষণা করেন তারাও এ কথা ভাল করে জানেন আমার ইন্টারনেট’এ কী দেখব সেও পরোক্ষ ভাবে কোম্পানি ও তাদের রাজনৈতিক সহযোগীরা নিয়ন্ত্রণ করে গুগল ছাড়াও সার্চ ইঞ্জিন আছে, ফেসবুক ছাড়াও সোশাল মিডিয়া আছে, সেগুলো পড়ে বাণিজ্য ব্যবস্থার আওতার বাইরে কিন্তু খুব অল্প সংখ্যক মানুষ তা ব্যবহার করেন কারণ সেগুলো খুব একটা user-friendly নয় User-friendly শব্দের ব্যবহারের মাধ্যমে বাণিজ্য জগৎ আরেক ভাবে ‘আমজনতা’ নির্মাণ করে। সে আলোচনা আজ থাক

Internet, citizen journalism, mailing list, blog, social media, P2P এই সব বহুদিনের, বহু চর্চিত বিষয় নতুন করে লেখার কিছু নেই এই শতকের শুরু থেকেই এই নিয়ে কাজকর্ম ও লেখালেখি চলছে নিস্ক্রিয় ভোক্তা থেকে সক্রিয় স্রষ্টায় পরিবর্তনের কথা অনেক হয়েছে এখন সময় এসেছে, সৃষ্টির মান নিয়ে কথা বলার সোশাল মিডিয়া ভরে গেছে আবর্জনায় ঘৃণা ও গুজব ছড়ানোর মুল মাধ্যম হল ‘আমজনতা’ গঠনমূলক ভাবনা-চিন্তা নয়, মিডিয়া প্রচারিত শোনা কথা অবলম্বন করে ‘আমজনতা’ যে বিষাক্ত মাল ছড়াচ্ছে সেখানে কোনওমুনাফার ব্যাপার নেই, সুতরাং কর্পোরেট খারাপ আর ‘আমজনতা’ ভাল এই তত্ত্বে আমরা উপনীত হই কিভাবে? ‘আমজনতা’ ও মিডিয়া দুজনেই দুজনের পরিপূরক

‘আমজনতা’র অত্যন্ত ন্যক্কারজনক অবস্থান দেখলাম JNU আন্দোলন চলাকালীন জাতি, বর্ণ নির্বিশেষে ‘আমজনতা’ যে ভাবে আচরণ করেছিল, দেখলে বা পড়লে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায় যেমন মিথ্যাচার, তেমনি ভাষা ঘেন্নায় গা গুলিয়ে ওঠে সাধারণ জ্ঞান ও মিডিয়া নির্ধারিত জ্ঞান ছাড়া ‘আমজনতা’ কিছু জানে না, জানতে চায় না কারন তারা ‘আমজনতা’, ভাসাভাসা জ্ঞান অর্জন করাই তাদের প্রাথমিক অধিকার তার ওপর, সে সময়ে সোশাল মিডিয়াতেমবমানসিকতার যে পরিচয় দেখলাম, তাতে শিহরিত হতে হয় একে অনায়াসে ‘মিডিয়া দাঙ্গা’র আখ্যা দেওয়া যায় এখনও JNUর ছাত্র-ছাত্রীরা পথেঘাটে নিজেদের পরিচয় দিতে ভয় পায়!

এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ মিডিয়াকে দোষ দিলে চলবে না। কারণ, আনন্দবাজার পত্রিকা, ইন্ডিয়া টুডে নিউস ও এনডিটিভি ঘটনাচক্রে খুবই ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছিল অনেকে মনে করেন তাদের সাংবাদিকরা আক্রান্ত না হলে হয়তো এই ভুমিকা পালন করত না কিন্তু ‘আমজনতা’ zee news ও টাইম্স নাওকে বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে করেছে। সে কি মিডিয়ার দোষ?

মানুষ তার রুচিবোধ অনুসারে তার সংস্কৃতি বেছে নেয় শাশুড়ি-বউ’এর ঝগড়া দেখব না সুচিন্তা সমৃদ্ধ সাহিত্য পড়ব - সে দায়িত্ব কার? আমি শুধু রিপু চরিতার্থ করব না তার ঊর্ধ্বে উঠব সে শুধুমাত্র আমার দায়িত্ব Exposer’এর দোহাই দিয়ে গা ঢাকলে কি চলবে? আজ স্মার্টফোন সবার হাতে হাতে গ্রে-মার্কেটের কল্যাণে অত্যন্ত প্রান্তিক মানুষের হাতেও আজ স্মার্টফোন দেখা যায় তাদের বাদ দিলেও, আপামর ‘শিক্ষিত জনতা’র ইন্টারনেট’এর যুগে Exposer’এর কোনও অভাব নেই, তবে তারা কোন যুক্তিতে মিথ্যায় বিশ্বাস করতে বেশি আগ্রহী হয় একটা চ্যানেলকে দেখলাম ডাহা মিথ্যে কথা বলছে, ‘আমজনতা’ হাঁ করে গিলছে আর তাতেই বিশ্বাস করছে

মিডিয়া কোনদিনও মানুষের জন্য ছিল না, হবেও না মানবিকতা, নীতি ও নৈতিকতা এবং যুক্তিপূর্ণ আলাপ-আলোচনার জন্য আমাদের সম্পূর্ণ অন্য পরিকাঠামোর কথা ভাবতে হবে মানুষকেও নিজেকে ‘আমজনতা’ নামক রাজনৈতিকভাবে নির্মিত ও পরিচালিত, স্বার্থকেন্দ্রিক জড় পদার্থ নয়, প্রেম ও সৌহার্দ, উপলব্ধি ও বুদ্ধিদীপ্ত সম্পন্ন প্রাণী হিসেবে দেখতে আরম্ভ করতে হবে

সব শেষে বলি, অনেকেই খুবই জরুরি ও অসাধারণ কাজ করছেন আগেই বলেছি ‘আমজনতা’ যেমন সব শ্রেণি, জাতি, ধর্ম ও সমাজে রয়েছে তেমনই সেইসব মানুষও সব শ্রেণি, জাতি, ধর্ম ও সমাজে রয়েছে ‘আমজনতা’ থেকে তাঁদের আলাদা করে দেখা একান্ত প্রয়োজন, তাঁদের ‘আমজনতা’র স্তরে নামিয়ে আনা অপরাধ কারণ, ‘আমজনতা’র স্বার্থকেন্দ্রিক মানসিকতা থেকে ওপরে উঠে ও কোনও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান দ্বারা চালিত না হয়ে তাঁরা তাঁদের কাজ করেন তাঁদের মানবিকতা, বোধ ও উপলব্ধির প্রতি আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল

তাঁরা ইন্টারনেট, প্রিন্ট, সভা, আলোচনা ইত্যাদির মাধ্যমে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কাজ করছেন এখানে বুঝতে হবে communication মানেই মিডিয়া নয়, public articulation মানেই মিডিয়া নয় তাঁদের কাজকর্ম মিডিয়ার নিয়মাবলী মেনেও চলে না বরং তার ঠিক বিপরীতই বলা উচিত অনেকে বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক মিডিয়ার কথা বলবেন প্রথমত, যারা সোশাল মিডিয়া ব্যবহার করেন সে ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যাপারটা খুবই জটিল, আমরা সচেতন ভাবে অংশগ্রহণ না করলেও, আমাদের ব্যবহারের মাধ্যমে সোশাল মিডিয়া তার মুনাফা তুলে নেয় সুতরাং, সেই কোম্পানিগুলোর মুনাফা হয় বলেই সোশাল মিডিয়া সাইটগুলো চলে আমরা তাদের হাতের পুতুলের মতোই, যতদিন না আমরা বাণিজ্যের বাইরে সামাজিক মত বিনিময়ের স্থান তৈরি করতে পারি দ্বিতীয়ত, এক তরফা প্রচারই মিডিয়ার অন্যতম পরিচিতি, শুধু বাণিজ্য নয় তাই সব থেকে আগে, আদেশ ও অনুজ্ঞার বিপরীত তাঁরা যুক্তিপূর্ণ আলোচনায় বিশ্বাস করেন, এছাড়া তাঁদের শেয়ার হোল্ডার নেই, পকেট ফাঁকা করে কাজ চালিয়ে যান, বিশেষ করে নাটক, লিটল ম্যাগ যারা চালান; TRP নেই, বরং অনেক কথাই ‘আমজনতা’র মন জুগিয়ে, অহং’এ সুড়সুডি দিয়ে বলেন না; মুনাফা নেই, বিজ্ঞাপনের থেকে কোটি কোটি টাকা আয় নেই নুন আনতে পান্তা ফুরলেও তাঁরা তাঁদের কাজ চালানোর চেষ্টা করেন সেখানে আদর্শ মুখ্য, মুনাফা নয়

তাই সেই কাজকে আমি মিডিয়ার দলে ঠেলে দিয়ে তাঁদের অপমান করতে চাই না সেই মানুষকে তাঁদের নিষ্ঠা, ত্যাগ ও পরিশ্রমকে ‘আমজনতা’ ও মিডিয়া দুটোই যথেষ্ট অশ্রদ্ধা করে, ‘আমজনতা’র হাতে বহুবার তাঁদের আক্রান্ত পর্যন্ত হতে হয়েছে তাই তাঁদের কথা বলতে হলে অন্য পরিভাষা চাই

তাই অনুরোধ, দয়া করে মুড়ি মুড়কি এক দর করবেন না